রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
ভালো নেই শ্রমিকরা

নেছারাবাদের জাহাজ শিল্প নানা সংকটে

নেছারাবাদ (পিরোজপুর) প্রতিনিধি
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
নেছারাবাদের জাহাজ শিল্প নানা সংকটে

পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা মূলত ব্যবসা সফল ও শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা। কৃষি পণ্যের উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও কাঠ ব্যবসার জন্য নেছারাবাদের নাম দেশব্যাপী পরিচিত। এর সঙ্গে উপজেলার হাজারো মানুষ জাহাজ নির্মাণশিল্প, ছোবড়াশিল্প, কাঠশিল্প, নার্সারি, কামারশিল্প, মৃৎশিল্প, ক্রিকেট ব্যাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শুধু এলাকার মানুষই নন, এসব শিল্পকে কেন্দ্র করে উপজেলার বাইরের খুলনা, রাজবাড়ী, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বহু লোকের এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এ উপজেলায় বাহন হিসেবে এক সময় কাঠের তৈরি নৌকা ও ট্রলারের প্রচলন থাকলেও এখন স্টিলের তৈরি লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গোর প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই এসব নৌযান তৈরির লক্ষ্যে উপজেলার স্বরূপকাঠি সদর, সোহাগদল, সুটিয়াকাঠি, তারাবুনিয়া, নাওয়ারা, কালীবাড়ি, বরছাকাঠি, ডুবিরহাট ও বালিহারিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। একটি বড় আকারের জাহাজ তৈরিতে সময় লাগে ৯ থেকে ১০ মাস।

জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা এসব ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন পেশায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। এদের প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ওভারটাইম নিয়েও কাজ করেন অনেক শ্রমিক। তারা সন্তোষজনক হারে মজুরি পেয়ে থাকেন।

আরও জানা যায়, বর্তমানে নৌযান নির্মাণের পেস্নট, ঝালাইকাঠি, রংসহ নানা ধরনের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযান তৈরির ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। আর এ কারণেই ডক-ইয়ার্ডগুলোতে নৌযান মেরামতের কাজ কিছুটা আগের মতো চললেও নতুন নৌযান নির্মাণ কমে গেছে। শুধু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণেই নয়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সড়কপথে পণ্য পরিবহণ বেড়ে গেছে। এ কারণে ট্রাকের কাঠামোসহ পরিবহণের নৌযান তৈরি কমে গেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই এলাকার ডকইয়ার্ড শিল্পের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

এ ব্যাপারে শ্রমিক নজরুল ইসলাম জানান, আগে এখানকার ডক-ইয়ার্ডগুলোতে এত পরিমাণ নৌযান তৈরি হতো যে শ্রমিকদের দিনে কাজ করার পরও রাতে ওভারটাইম করতে হতো। ইদানীং জাহাজ নির্মাণ কমে যাওয়ায় শ্রমিকের চাহিদা কমে গেছে। বেতনও আগের তুলনায় কম। বেকার হয়ে পড়েছেন অনেকেই।

হাওলাদার ডক-ইয়ার্ডের কন্ট্রাক্টর জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, জাহাজ তৈরির জন্য যে পেস্নটসহ অন্য কাঁচামাল ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ নির্মাণ বা সংস্কারে মালিকদের আগ্রহ কমেছে। আগের ৮৫ থেকে ৯৫ হাজার টাকার প্রতি টন পেস্নট এখন এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে।

শুধু ডকইয়ার্ডেই নয়, এ শিল্পকে কেন্দ্র করে উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হার্ডওয়্যার, রং ও যন্ত্রপাতির দোকান গড়ে উঠেছে। সেখানেও বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফরাজি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মাসুম ফরাজি জানান, আগে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার রং বেচাকেনা হতো। বর্তমানে মূল্য বৃদ্ধির কারণে জাহাজ নির্মাণ কমে যাওয়ায় প্রতি মাসে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার বেচাকেনা হচ্ছে।

উপজেলা সদরের মেসার্স ছালেহীয়া ডকইয়ার্ডে বর্তমানে মেসার্স পাতারহাট শিপিং লাইনসের এম ভি দোয়েল পাখি-১০ নামক লঞ্চটি নির্মাণাধীন আছে। লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ১৯৫ ফুট এবং প্রস্থ ৪২ ফুট। ওই ডকইয়ার্ডের পরিচালক মো. নূর এ কাওসার বাবু জানান, আগে ডকে জাহাজ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য জায়গা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। আর এখন নির্মাণ কমে যাওয়ায় বহু জায়গা খালি পড়ে থাকে। কাজ না থাকায় শ্রমিকদের বেকার বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। অগ্রগতি ডকইয়ার্ড শিপবিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী সেলিম হাসান জানান, তার ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও স্বরূপকাঠির নাওয়ারায় দুটি ডকইয়ার্ড রয়েছে। সেখানে প্রায় ৩০০ জন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী স্ক্র্যাপ, পেস্নট, অ্যাঙ্গেল ও ঝালাই কাঠির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এগুলোর দাম বৃদ্ধি করায় বর্তমানে জাহাজ নির্মাণ ও সংস্কার কমে আসছে। ফলে আর্থিকভাবে তারা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নেছারাবাদ বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মোজাহিদুল ইসলাম আসাদ বলেন, প্রায় ৪০ বছর স্থানীয় পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের উদ্যোগে এই ব্যবসা চালু করেন। এর ফলে এখানে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। শিল্প উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে এর পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে। সরকার এই সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে কিভাবে এর পরিসর আরও বাড়ানো যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।

নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, ডকইর্য়াডগুলো আরও উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ডকইয়ার্ডের শিল্প আরও বিস্তৃতি লাভে কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নেছারাবাদ জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন সবসময় তাদের দিকে নজর রাখছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে