রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
কারফিউ'র প্রভাব

মেহেরপুরের সবজি চাষিদের মাথায় হাত

গোলাম মোস্তফা, মেহেরপুর
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
মেহেরপুরে কৃষকের ক্ষেতে ঝুলছে স্বপ্নের লাউ -যাযাদি

মেহেরপুরে কোটাবিরোধী কোনো আন্দোলন ও সহিংস ঘটনা না ঘটলেও দেশের অন্যান্য জেলার সহিংস ঘটনার জের মেহেরপুরের কৃষকদের লোকসানের মুখে ফেলে দিয়েছে। সবজির জেলা হিসেবে পরিচিত মেহেরপুর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০-৪০ ট্রাক নানা ধরনের সবজি ঢাকা, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয়। হঠাৎ কোটাবিরোধী আন্দোলনে নাশকতাকারীরা ঢুকে গিয়ে যত্রতত্র গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় কোনো ট্রাক আর মেহেরপুর ছেড়ে যাচ্ছে না। তার উপরে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জারি করা হয়েছে কারফিউ। কারফিউ চলাকালীন প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় মেহেরপুরের চাষিরা তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে না পেরে চরম লোকাসনের মুখে পড়েছেন।

স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সবজি বাজারে তোলা হচ্ছে। সঠিক সময়ে সবজি তুলতে না পেরে জমিতেই রাখতে হচ্ছে। এদিকে এখন বর্ষা মৌসুম। ভারী বৃষ্টিপাতে অনেক ক্ষেতের সবজি পচে নষ্ট হচ্ছে। তাই সঠিক সময়ে সবজি বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে তারা।

এ জেলার উৎপাদিত সবজি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় দেশের অন্যান্য বড় সবজি বাজারে। বিশেষ করে শীতকালীন সবজি এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও উৎপাদিত হয়ে থাকে মেহেরপুরে। বর্তমানে মেহেরপুরের মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে বেগুন, কাঁচা মরিচ, পাতা কপি, ফুল কপি, পটল, ঝিঙ্গে, চিচিঙ্গা, কলা, কুমড়া, শশা, লাল-শাক, সাদা শাক, পুঁইশাক, করলা, কাকরোল, পেঁপে, ওল, কচু, লাউসহ প্রায় সব ধরনে সবজি। এসব সবজি চাষ করে কৃষক তাদের স্বপ্ন পূরণ করাসহ পরবর্তী চাষাবাদের টাকা জোগাড় করে থাকেন।

সদর উপজেলার উত্তর শালিকা গ্রামের চাষি সোহাগ রহমান বলেন, 'আমি চার বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টাকার মরিচ বিক্রি করি। আরও অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মরিচ বিক্রি হবে বলে আশা করেছিলাম। তবে মরিচ বাইরে পাঠাতে না পারায় জমি থেকে তুলতে পারছি না। সঠিক সময়ে বিক্রি করতে না পারলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ব।'

চলতি মৌসুমে মেহেরপুর জেলায় প্রায় ৮৯০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। উৎপাদিত কাঁচা মরিচ পাইকারি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। মরিচ এখন বাইরের জেলাতে পাঠাতে না পারার কারণে বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে। এই বর্ষা মৌসুমে মেহেরপুরে প্রায় ৭৬২ হেক্টর জমিতে বাঁধা কপির চাষ হয়েছে। বাজার দর ভালো থাকায় বাঁধা কপি চাষে লাভবান হচ্ছিল চাষি।

গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের কপি চাষি জুলি মহাম্মদ বলেন, আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে এই বর্ষায় মাত্র ৯০ দিনে কপি বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমিতে সার-বীজ, কীটনাশকসহ চাষ খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদিত কপি বিক্রি করে ঘরে আসছে ৯০ থেকে এক লাখ টাকা। খরচ বাদে লাভ হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। অথচ বর্ষায় কপি সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারলে জমিতে পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে লোকসানের কবলে পড়তে হবে।

মেহেরপুর বড় বাজারের খুচরা সবজি ব্যবসায়ী কালু মন্ডল বলেন, হঠাৎ দেশে অস্থিরতার কারণে বাজারে সবজির দাম অনেক কমে গেছে। বাইরের সবজি পাঠাতে না পারায় চাষিরা লোকসানের মধ্যে পড়েছেন। জেলায় যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় তার সামান্যই মেহেরপুরের বাজারে বিক্রি হয়। অধিকাংশ সবজি সরবরাহ করা হয় বাইরের জেলায়। ক'দিন আগেও বাজারে সবজির দাম ছিলো আকাশচুম্বি। দেশে অস্থিরতার কারণে স্থানীয় বাজারে ৭০-৮০ টাকার বেগুন ৩০-৩৫ টাকায়, ২৫০-৩০০ টাকার কাঁচা মরিচ ১৭০-১৮০ টাকায়, ৪০-৪৫ টাকার পাতা কপি ২৫-৩০ টাকায়, ৫০-৬০ টাকার ফুল কপি ৩০-৪০ টাকায়, ৫০ -৬০ টাকার পটল-৩৫-৪০ টাকায়,৭০-৮০ টাকার ঝিঙ্গে ৩৫-৪০ টাকায়, ৪৫-৫০ টাকার চিচিঙ্গা ২৫-৩০, ৪০-৫০ টাকার শশা ২৫-৩৫ টাকায়, ৪০-৫০ টাকার লাউ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনি ভাবে প্রায় সব সবজির দাম অর্ধেক নেমে এসেছে। তার ওপরে স্থানীয় বাজারেও ক্রেতা কম। সবজি বিক্রেতারা মানুষের বাড়ির আশপাশে গিয়ে সবজি বিক্রি করছে। তাই বাজারে এখন বেচাকেনা খুবই কম।

কাঁচা মালের আড়তদার মিজানুর রহমান বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে এ বছর সবজির দাম ছিল সর্বোচ্চ। হঠাৎ দেশে অস্থিরতার কারণে বাইরের পাইকাররা মেহেরপুর ছেড়ে গেছে। তাই আড়তে এখন স্থানীয় কাঁচা মালের ফড়িয়ারাই ভরসা। চাহিদার তুলনায় আমদানি অনেক। অথচ বিক্রির জন্য ক্রেতা নেই। এতে জেলার কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ট্রাক মালিক হাফিজুর রহমান জানান, 'সড়কে যেভাবে গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে তাতে আমরা সবজিবোঝাই ট্রাক পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও গাড়ি পাঠানো হবে।'

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালাদার জানান, জেলায় ব্যাপক হারে সব ধরনের সবজির চাষ হয়ে থাকে। বাজার দরও ভালো। কৃষক লাভবান হচ্ছিলেন। হঠাৎ পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তবে প্রশাসন থেকে সবজি সরবরাহে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেও ট্রাক মালিকরা এখনো আতঙ্কে আছেন। এ কর্মকর্তার আশা শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে