অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ঢলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। এর ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়ে একাধিক স্থানের বাঁধ ধসে গেছে। রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও গ্রামের পর গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে ফসল ও সবজি ক্ষেত। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীতে শনিবার দুপুরে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। একটি বাঁধ ঝুঁকিতে ও রাস্তা ভেঙে একটি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি জায়গা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। ভেঙে গেলে আরও ৬টি গ্রামে পানি ঢুকবে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জানা যায়, তীব্র স্রোত ও ব্যাপক ভাঙনের শিকার কাজলা ইউনিয়নের চর ঘাঘুয়া ও টেংরাকুরা এলাকা। চর ঘাঘুয়ায় নদী রক্ষা বাঁধটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টেংরাকুরার একটি রাস্তা ধসে গিয়ে একটি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। চর ঘাঘুয়াতে নদী রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। নদী থেকে যে ঢেউ তৈরি হবে তা যেনও বাঁধে সরাসরি আঘাত করতে না পারে এ কারণে বাঁধের দক্ষিণে ২০১০ সালে তৈরি করা আরেকটি বাঁধের সামনের মাটি কেটে গোল চত্বর করা হয়। যেখানে বাঁধটি সামনের মাটি কাটার পর তা বাঁধার আগেই বন্যার পানি হুহু করে ঢুকে যায়। বাঁধটির সামনের দিকে লাগানো ১৫০ থেকে ২০০টি গাছসহ জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন প্রতিনিয়ত একটু করে বাঁধের মাটি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। যে কোনো সময় বাঁধটি সম্পূর্ণভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
চর ঘাঘুয়ার বাসিন্দা তালেব আলী মোলস্না বলেন, এগুলো তো ভাঙার কথা না। নদীতে গোল চত্বর করছে। তারপর নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলেই ভাঙা শুরু হয়। চর ঘাঘুয়ার এ মূল বাঁধ থেকে ২ মিটার দূরে ছিল নদী। এখানে তার প্রায় ৩শ' গাছ ছিল। দেড় বিঘার মতো জমি ছিল। এই গোল চত্বর করার সময় তার জমি নেয়। সেটার বিনিময়ে কোনো টাকা পাননি। তারপরও এতগুলো গাছ নদীতে চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে বাঁধটাই থাকবে না। এ বাঁধ যে কোনো সময় ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে যেতে পারে। এখন ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা।
এদিকে পানি বাড়তে থাকায় উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের টেংরাকুড়া চরের একটি রাস্তা ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। গত বৃহস্পতিবার বিকালে রাস্তাটির ২০ ফিট অংশের মাটি ধসে গিয়ে এ গ্রামের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি এবং কৃষিজমির ফসল পস্নাবিত হয়েছে। ভেঙে যাওয়া রাস্তাটির আরও একটি অংশ ধসে গিয়ে সেখানে বিশালাকার গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানেও ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এখানে রাস্তাটি ভেঙে গেলে টেংরাকুড়া, উত্তর টেংরাকুড়া, দক্ষিণ টেংরাকুড়া, জামথল, দক্ষিণ জামথল এবং বেড়াপাঁচবাড়িয়া গ্রাম পস্নাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এসব গ্রামের ২০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাস্তাটি ভেঙে গেলে এসব গ্রামে অবস্থিত ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে দ্বিতীয় দিনের মতো পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার ৭৫টি গ্রামের ৪৯ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
উপজেলার ৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে পস্নাবিত হয়েছে এবং ৮ হাজারের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে উপজেলার ৩২ হাজার ছাগল এবং ৪৩ হাজার গরুসহ বেশকিছু গৃহপালিত পশু। উপজেলার ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিবন্দি হয়েছে।
কাজলা টেংরাকুড়া চরের শাহজাহান আলী বলেন, টেংরাকুড়া গ্রামের রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ায় পুরো ইউনিয়নের এলাকাবাসীর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষজন পানিবন্দি হয়েছে। রাস্তাটির অপর পাশের ধসে যাওয়া অংশ ভাঙন হুমকিতে রয়েছে এবং সেখানে ৬টি গ্রাম পস্নাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চর ঘাঘুয়ার বাঁধটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বাঁধ ভেঙে গেলে এই পুরো এলাকায় বন্যার পানি সরাসরি ঢুকবে। বাঁধটি রক্ষা করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ন কবির বলেন, 'আমাদের কর্মকর্তারা বাঁধটি পরিদর্শন করেছেন। কী রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা রিপোর্ট আকারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওখান থেকে নির্দেশনা আসলে আমরা পরবর্তী কাজ শুরু করব।'
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং ভারী বর্ষণের ফলে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা নদীতে বাড়ছে পানি। বিরাজ করছে বন্যা। চরাঞ্চলসহ যমুনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করছে। নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের পাট ও তিলসহ নানান জাতের সবজি।
সরেজমিন গিয়ে শনিবার উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের এলাকা ঘুরে দেখা যায় খানুরবাড়ি, ভালকুটিয়া, চিতুলিয়াপাড়া, কষ্টাপাড়া গাবসারা চর গাবসারা ও পুংলিপাড়া এবং নিকরাইল ইউনিয়নের মাটিকাটা, পাটিতাপাড়া ও বাহাদুর টুকনা এলাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় কয়েকদিন ধরে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে এসব এলাকার মানুষ খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নষ্ট হয়ে গেছে ক্ষেতের পাট ও তিলসহ নানা জাতের সবজি।
খানুরবাড়ির সবজি চাষি আব্দুল মজিদ বলেন, 'আমার নিজের বাড়ি ও জমি নাই, অন্যের জাগায় থাকি আর অন্যের জমিতে সবজি আবাদ করে সংসার চালাই। বন্যায় সব চালকুমড়া আর শসার ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এখন আমরা কোথায় যাব আর কী খাব। সারাদিনে একবার খাই।' জোয়াদ আলী জানান, 'আমার ২০ শতক জমির ঢেড়শ সবজি পানির তলে। খরচের টাকাও তুলতে পারিনি।'
যমুনা তীরবর্তী ভাঙনকবলিত পাটিতাপাড়া বাহাদুরটুকনা এলাকার আবু সুফিয়ান ও জালাল প্রামাণিক বলেন, যমুনা নদীটি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দেড় থেকে দুই মাইল দূরে ছিল। গত কয়েক বছর ধরে যমুনার ভাঙনে আমাদের ফসলের জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের থাকার জায়গাটুকুও ভেঙে যাচ্ছে। এদিকে যমুনায় পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পস্নাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ক্ষেতের ফসল ও সবজি-তরকারির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার্ত মানুষগুলো মাথা গোঁজার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে উঁচু জায়গা। তারা বিশুদ্ধ পানি এবং নিজেদের খাদ্য সংকটে পড়েছে, উপরন্ত গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর আত্রাইয়ে একাধিক স্থানে বাঁধ ধসে গিয়েছে। এসব বাঁধ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধসে যাওয়া স্থানগুলো পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রম্নত মেরামতের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রানীনগর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক সুমন।
জানা যায়, গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণে আত্রাই-সিংড়া বাঁধের ডুবাই নামক স্থানে এবং আত্রাই-বান্দাইখাড়া বাঁধের লালুয়া নামক স্থানে ধস দেখা দেয়। গত শুক্রবার বিকালে এ দু'টি স্থানে সামান্য ধস দেখা দিলেও রাতের মধ্যে পুরো সড়ক ধসে যায়। ফলে আত্রাই-সিংড়া ও আত্রাই-বান্দাইখাড়া সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে গত শুক্র ও শনিবার এসব ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রম্নত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক সুমন।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ধসে যাওয়া স্থানগুলো মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে। শিকারপুর গ্রামের রনি, ডুবাই গ্রামের আমিরুজ্জামান মধু, মদনডাঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা খোদাবক্স মোলস্না, আব্দুর রশিদ, স্থানীয় ইউপি সদস্য ইদ্রিস আলী, জিএম আল মামুন বলেন, ইঁদুর ও শিয়ালের গর্ত থেকে এ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। শিগগিরই টেকসই সংস্কার না করলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে এ স্থানগুলো ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হবে।
সংস্কার কাজ তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম ও মাহবুবুর রহমান জানান, 'টেকসই সংস্কারের জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এখানকার বালু মাটি উঠিয়ে পলি মাটি দ্বারা ভরাট করা হবে।'
স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক সুমন বলেন, 'এ বাঁধগুলো টেকসই সংস্কারের জন্য আমি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে ডিও দিয়েছি। তিনি কাজগুলো করার জন্য আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। গত শুক্রবার থেকে আমার নির্বাচনী এলাকার এ বাঁধগুলোর সংস্কার কাজ আমি উপস্থিত থেকে পরিদর্শন করছি।'
বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, নিকলী, কুলিয়ারচরসহ হাওড় অধু্যষিত উপজেলাগুলোয় সিলেট থেকে নেমে আসা পানিগুলো ভারী বর্ষণ ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে গত কয়েকদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় পানি বেড়েই চলেছে। এসব নদী তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার গ্রামবাসী আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে। বাজিতপুর উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের কচুয়াখলা, আছানপুর, বলিয়ারদী ইউনিয়নের বাহেরবাউলী, মাইজচর ইউনিয়নের আয়নারগোপ, মাইজচরের উত্তর ও দক্ষিণপাড়াসহ নিম্নাঞ্চলের বাড়ি-ঘরগুলো পানিতে ডুবুডুবু ভাব। এদিকে নিকলী উপজেলার ছাতিরচর, সিংপুর ইউনিয়নের ধনু নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাড়িগুলো অতিরিক্ত স্রোতের কারণে গ্রামগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। যদিও এই দুই উপজেলার আছানপুর, ছাতিরচর, সিংপুর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য ১৬২ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে। কিন্তু নদীতে পানি আসার কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজগুলো আপাতত কয়েক মাসের জন্য বন্ধ বয়েছে।
অন্যদিকে নদী তীরবর্তী এলাকার বানভাসি গরিব মানুষগুলো বর্তমানে কোনো কাজ না থাকায় খেয়ে-না খেয়ে কোনো রকমভাবে দিন যাপন করছে।