'আষাঢ়ে বাদলে নামিল ঢল, খাল বিল থই থই', কবির ভাষার এই ছন্দের সঙ্গে আষাঢ় এলেই তার হুবহু প্রমাণ মেলে। সারা বছর সুতাং নদী যেন বর্ষা আর আষাঢ়ের জন্যই অপেক্ষা করে, কবে নদীতে প্রাণের সঞ্চার হবে, আর নদী তার ভরা যৌবনে রূপ নেবে।
পাহাড়ের কোলঘেঁষা সুতাং নদী ছিল এককালের খরস্রোতা। নদীর জোয়ারে পাড় উপচে পানি বয়ে যেত। কালের পরিক্রমায় নদীর মাধুর্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে, তবুও প্রতি বছর বর্ষা কিংবা আষাঢ়ে নদীতে পানি আর স্রোতে হয় প্রাণের সঞ্চার। নদীটি একসময় বছরের বেশির ভাগ সময়েই থাকত পানিতে ভরপুর। নদীপাড়ের মৎস্যজীবীরা মনের আনন্দে মেতে উঠতেন মাছ শিকারে। চালস্নাইর বিলের কই আর সুতাংয়ের পুঁটিমাছের ঐতিহ্য সারা জেলায় প্রসিদ্ধ ছিল।
এখন পানির মৌসুম চলছে, একটানা বৃষ্টিতে নদীর পানি এখন টইটম্বুর হয়ে আছে। চারদিকে পানি থাকায় নদীতে জোয়ার এসেছে। প্রাকৃতিক পানিতে ভরপুর সুতাং নদী যেন খানিকটা হলেও পুরানো যৌবন ফিরে পেয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, স্থানীয় জেলেরা নদীতে জাল ফেলে মনের আনন্দে মাছ শিকার করছেন। সুতাং নদীর সৌন্দর্য দেখার জন্য অনেক মানুষ এসে নদীর পাড়ে ভিড় করছেন। কেউ কেউ ডিঙি নৌকায় মাছ ধরছেন, আবার অনেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ভাটি অঞ্চল থেকে দলবেঁধে ডিজে পার্টিসহ ভ্রমণ করতে এসেছেন। সম্প্রতি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই অসংখ্য নৌকা পাড়ে বেঁধে রেখে উৎসবের আমেজে পিকনিক করতে দেখা গেছে ভ্রমণ পিপাসুদের। নদীর পানি এখন স্বচ্ছ থাকায় সকাল কিংবা দুপুরে নদীতে সারিবদ্ধভাবে স্থানীয়দের গোসল করতে দেখা যায়, ছেলেদের দুরন্তপনায় পানিতে ডিগবাজি দিয়ে গোসল করছে। এখন আগের মতো প্রতি রবি ও বুধবারে দূরদূরান্ত থেকে ইঞ্জিনের চালিত নৌকায় ভাটি অঞ্চলের মানুষজন হাটবাজার করে আবার ফিরে যাচ্ছেন, দেখতেই যেন অনেক ভালো লাগে।
কেউ কেউ ভেলা বানিয়ে মনের সুখে নদী পার হচ্ছেন। এমন দৃশ্যের প্রায়ই দেখা মেলে। রাত করে সুতাং নদীর দৃশ্য দেখতে গেলে এখন দেখা মেলে স্থানে স্থানে মাছ শিকারিদের। তাদের অনেককে মশাল জ্বালিয়ে মাছ ধরতেও দেখা যায়। আর তরুণ ছেলেরা নদীর ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কেউ টিকিটক বানাচ্ছে, কেউবা সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।
স্থানীয় মাছ শিকারি সোবেল মিয়া জানান, রাতের বেলা দেশীয় প্রজাতির বেশ ভালো মাছ ওঠে। এসব মাছের মধ্যে পুঁটি, শিং ও বোয়াল রয়েছে।
তিনি জানান, শখের বসেই মাছ ধরতে আসেন, বৃষ্টির সময় মাছ ধরা দেয় বেশি। এসব মাছ ধরে তার পরিবারের মাছের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, সুতাং নদীতে পানি থাকায় স্থানীয় বাঁশ ব্যবসায়ীরা বাঁশের আঁটি বেঁধে পানিতে ভাসিয়েই উজান থেকে ভাটিতে নিয়ে যান। এতে করে তাদের অতিরিক্ত পরিবহণ খরচও বেঁচে যায়।
এক সময় সুতাং নদী দিয়ে প্রতিদিনই বড় বড় নৌকা আসা-যাওয়া করত। আর এসব নৌকায় করে ভাটি এলাকার বাদগরি, কাডাখালী, সাধুরবাজারসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে মানুষ নিয়মিত সদাই করে আবার নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন কেবলই বর্ষার মৌসুমে এ দৃশ্য দেখা মিলে, এছাড়া আর নৌপথে এভাবে মানুষজন আসতে দেখা যায় না। বর্ষার মৌসুমেই কেবল ঐতিহ্যবাহী এ নদীতে পানি থাকে। অন্য সময় শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়, পায়ে হেঁটেই নদী পার হয়ে যান মানুষজন।
এ বিষয়ে বাপা হবিগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাহী সদস্য (কেন্দ্রীয় কমিটি) তোফাজ্জল সোহেল বলেন, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সুতাং নদী একটি সীমান্তবর্তী নদী। বর্ষার মৌসুমে এর আসল রূপ দেখা যায়, যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। সুতাং নদীটি নানা সমস্যায় জর্জরিত, যে কারণে বর্ষার মৌসুম গেলেই নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ওঠে, নদীতে পানি থাকে না। এখনো ভাটি অঞ্চলের মানুষ পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নৌকার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশ শুকিয়ে যাওয়ায় তারাও নৌপথে যাতায়াত করতে পারেন না। সুতাং নদীর হারানো ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে দখল ও দূষণের হাত থেকে এই নদীকে বাঁচাতে হবে। না হলে এই নদীর মৃত কান্নার শেষ কখনোই হবে না। আমরা সুতাং নদী নিয়ে অনেক কাজ করেছি, আমাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো নদী রক্ষায় দ্রম্নত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখি।
এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার মিতা জানান, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত না হওয়ায় শুকনো মৌসুমে সুতাং নদী শুকিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত সুতাং নদী খননের বিষয়ে সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেই, আমি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।
এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ তালুকদার ইকবাল জানান, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী হলো সুতাং নদী, আমরা চাই সুতাং নদী খনন হোক। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার পক্ষ থেকে নদী খননের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই।