'বাবা প্রসঙ্গ এলেই নিভৃতে কাঁদতে দেখেছি মাকে। ছোট তিন ভাইবোন নিয়ে আমাদের পরিবার। সারাটি জীবন মায়ের কষ্ট, যন্ত্রনা দেখেছি। স্বাধীনতা বা বিজয়ের দিন এলেই মা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলতেন। আমি জানি বাবা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু একটিবারের জন্যেও কি তার কবরের মাটি স্পর্শ করতে পারব না? একটি দীর্ঘশ্বাস সারা জীবন তাড়িয়ে নিয়েছে আমায়। ছাত্রজীবন থেকেই যেখানে শুনেছি গণকবর বা মুক্তিযোদ্ধাদের নিশানা পাওয়া গেছে ছুটে গেছি সেখানে। এভাবে ৬৪ জেলার সবটাই চষে বেরিয়েছি আমি। বাবা ইলিয়াস আহমেদ যখন যুদ্ধে যান, আমি তখন ছয় বছরের শিশু। সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। কিন্তু কোথায়, কবে শহীদ হলেন, কিছুই জানতাম না। এমনকি ৫০ বছরেও বাবার কবরের হদিস পাইনি।'
কথাগুলো বলছিলেন শহীদ ইলিয়াস আহমেদের বড় ছেলে কৃষিবিদ ড. মহা. শফিকুল আলম। একটা অতৃপ্ত যন্ত্রণা অহর্নিশ তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। নিজের মতো করে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন তিনি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) রেজিস্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত, সেই সুবাদে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার সহকর্মীদেরও বলে রেখেছিলেন, তার বাবার কবরের সন্ধান যদি কেউ দিতে পারেন! ঈদের ছুটিতে এসে গত শুক্রবার শহীদ বাবা ইলিয়াস আহমেদের কবরে দোয়া মোনাজাত শেষে স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের এভাবে বলেন ড. শফিক।
তিনি আরও বলেন, অবশেষে সাড়া পেলেন বাউবির পাবনা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে। তিনি একটি বইয়ের সন্ধান দিলেন। বইটি তিনি ড. শফিককে পাঠান। পাবনার সাঁথিয়ায় যুদ্ধের ইতিবৃত্ত আছে বইটিতে। সেই বইয়েই লুকিয়ে ছিল শফিকের বাবার নাম, আর তার যুদ্ধের গল্প। বই পড়ে সাঁথিয়ায় ছুটে যান শফিক। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন। এখানেই ডাব বাগানের যুদ্ধে শহীদ হন তার বাবা তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সিপাহী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ। এখানেই হয়েছে তার বাবার কবর। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার কবরের সন্ধান পেলেন তার সন্তান, তাও ৫০ বছর পর। সেই কবর দেখতেই সপরিবারে আসেন ড. শফিক। এভাবেই পাঁচ দশক পর রচিত হয় নতুন এক অধ্যায়ের।
ড. শফিকুল আলমের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোনাকষা ইউনিয়নের রানীনগর গ্রামে। তিনি জানালেন, তার বাবার কর্মস্থল ছিল নওগাঁয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন কয়েক দিন ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন। বাড়িতে থাকতেই খবর পান, বাঙালি ইপিআর, পুলিশসহ অকুতোভয় মুক্তিসেনারা দলে দলে যুদ্ধে যাচ্ছেন। ইলিয়াসও ঘরে বসে থাকেননি। বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। সেই যে বেরিয়েছিলেন, আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কোনো খোঁজও মেলেনি। শুধু বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন তিনি। কিন্তু কবে, কোথায়, কীভাবে তিনি শহীদ হলেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা।
পাবনার সাঁথিয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নিজাম উদ্দিন। সম্প্রতি তার লেখা 'একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' নামে একটি বই প্রকাশ হয়। বইয়ে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। বইয়ের একটি অংশে একাত্তরে ডাব বাগান (পরে নাম হয় শহীদনগর) যুদ্ধের ঘটনার বর্ণনাসহ শহীদদের নামের তালিকা রয়েছে। সেখানে গ্রামবাসীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হওয়া ১৭ জন ইপিআর জওয়ানের নাম আছে। তালিকার সপ্তম নামটি ইলিয়াস আহমেদের। এছাড়া লড়াইয়ের স্থান অর্থাৎ শহীদনগরে শহীদদের স্মরণে 'বীরবাঙালি' নামের যে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, সেখানেও ইলিয়াস আহমেদের নাম রয়েছে। এই বইটি পড়ে গত মে মাসে শফিক জানতে পারেন তার বাবা শহীদনগরের যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন। তিনি সাঁথিয়ার শহীদনগরে যান। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে নিশ্চিত হন, তার বাবা সেখানেই শহীদ হয়েছেন।
সে সময় কাছাকাছি তিনটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে গ্রামবাসী শদীদদের গণকবর দিয়েছিলেন। গণকবর তিনটির যেকোনো একটিতে ইলিয়াসকে সমাহিত করা হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তিনটি গণকবরের ঠিক কোনটিতে তার দেহ আছে, তা জানা যায়নি। তাতে আপত্তি নেই শফিকুলের। শহীদনগর গ্রামে বাবার কবর আছে, এটুকু জানতে পেরেই স্বস্তি পেয়েছেন।
শহীদনগর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল লতিফ (৭৫) বলেন, ইপিআর সদস্যরা তাদের বাড়িতে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। হানাদারদের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের সবাই পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে যুদ্ধের দুই-তিন দিন পর তারা গ্রামে ফিরে দেখেন, এখানে-সেখানে পিআর জওয়ান ও গ্রামের লোকজনের লাশ পড়ে আছে। পরে কয়েকটি জায়গায় তাদের কবর দেওয়া হয়। নিহত ইপিআর জওয়ানদের সবার নামই পরবর্তী সময়ে জানা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ইলিয়াস আহমেদও ছিলেন।
'একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' বই থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পাবনা-বগুড়া সড়কের সাঁথিয়া উপজেলার শহীদনগরে (তৎকালীন নাম ডাববাগান) সম্মুখ সমরে শহীদ হন ইলিয়াস আহমেদ। সেদিনের যুদ্ধে তিনি ছাড়াও ইপিআরের ১৭ সদস্য ও গ্রামের ১৫ বাসিন্দা শহীদ হয়েছিলেন। শফিকুল আলম বলেন, '৫০ বছর ধরে বাবার কবর খুঁজে ফিরছিলাম। এ সম্পর্কিত যে কোনো বই, দলিল দস্তাবেজের সন্ধান পেলেই আমি সংগ্রহ করি। এখন আমাদের পরিবারের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। আজ কিছুটা হলেও শান্তি পাচ্ছি। পরিবারের সব সদস্য মিলে আমরা বাবার কবরে গিয়ে দোয়া মাহফিলে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একটি শহীদ পরিবারের জন্য এই আনন্দ কতটা তা কোনো দিন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।'