গাংনীর যুব সমাজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যেমন ব্যাপক ভূমিকা রাখছে তেমনি এর একটা অংশ ঝুঁকে পড়েছে মাদক পাচারে। মাদকের সহজ লভ্যতার কারণে অনেকেই আসক্ত হচ্ছে মাদক সেবনে। শুধু যুবকই নয় বিভিন্ন বয়সিদের পাশাপাশি নারীরাও জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবনে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের একরকম উদাসীনতার কারণে মাদক পাচার ও মাদক সেবীদের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল। তবে প্রশাসন বলছে মাদকের বিরুদ্ধে জোর অভিযান চলছে।
গাংনী থানা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গাংনীতে পুলিশি অভিযানে পুলিশ ৫৬ মাদক মামলা রুজু করে। এসময় উদ্ধার হয় ১০২৬ বোতল ফেনসিডিল, ৭ কেজি ৩৮০ গ্রাম গাঁজা, ৬৪ গ্রাম হেরোইন ও ১৭৫ পিস ইয়াবা।র্ যাব কর্তৃক মামলা হয় ১২টি। উদ্ধার হয় ১৬৫ বোতল ফেনসিডিল, ১১ কেজি ৫৫ গ্রাম গাঁজা, ১০.৪৫ গ্রাম হেরোইন ও ৩৫৪ পিস ইয়াবা। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মামলা করে ১০টি, উদ্ধার হয় ২৬৫ বোতল ফেনসিডিল, ১০ কেজি গাঁজা, ১০ গ্রাম হেরোইন ও ২০ পিস ইয়াবা। বিজিবি মাত্র দুটি মামলা করে। এসময় মাত্র ২১৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার দেখানো হয়।
পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানের বেশ সফলতা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিহিত করেছেন সচেতন মহল। গত ২০ জুন ৬৩০ বোতল ফেনসিডিল, ১৫০ গ্রাম গাঁজা ও ৪ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে পুলিশ। তবে এটি বৃহৎ চালানের ক্ষুদ্র একটা অংশ মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির মাদক উদ্ধারে এক রকম নিষ্ক্রিয় ভূমিকা বলে মনে করছেন প্রশাসন ও স্থানীয়রা। তাদের মতে, পুলিশ ওর্ যাব বিপুল সংখ্যক মাদক উদ্ধার ও পাচারকারীদের আটক করেছে। আর সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি মাত্র দুটি মামলা করেছে।
সীমান্ত গলিয়ে কিভাবে মাদক পাচার হয়ে আসছে সেটি এখন বেশ আলোচনায়। এ নিয়ে গত ২৪ জুন উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা ও চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির বৈঠকে বিজিবি ও পুলিশ উভয়পক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করে।
একাধিক মাদক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় নগদ টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে মাদক কিনে আনতেন। বর্তমানে স্বর্ণের বার ওপারে পাচারের বদলে এ পারে আসে মাদক। মাদকের ব্যবসা হচ্ছে তিনটি ধাপে। একটি দল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাদক নিয়ে আসে। তারা পৌঁছে দেয় এজেন্টদের কাছে। এজেন্টরা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খুচরা বিক্রেতাদের দিয়ে এসব মাদক বিক্রি করায়। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের মাদক বিক্রি, পরিবহণ ও খুচরা বিক্রির কাজে ব্যবহার করছেন নেপথ্যে নায়করা। তারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মাদক পাচারের ব্যাপারেও পাওয়া গেছে বিচিত্র সব তথ্য। পাচারকারীরা জানায়, সীমান্তের এপার থেকে কাঁটাতারের ওপারে স্বর্ণের বার কিংবা অন্যান্য মালামাল নিক্ষেপ করা হয়। বিনিময়ে টেপ দিয়ে মোড়ানো মাদক এপারে ফেলে দেওয়া হয়। সেগুলো সুযোগ বুঝে সংগ্রহ করে সীমান্তের কাছাকাছি কোনো বাড়িতে মজুদ করা হয়। পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন মাধ্যমে ছোট ছোট করে মাদক বড় শহরগুলোতে পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের নজর এড়াতে বোরকা পরিহিত নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হয় অনেকাংশে।
জেলা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শিরীন আকতার জানান, মাদক নির্মূলে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়; মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেপথ্য নায়কদের আটক করা সম্ভব হয় না। এসব ঘটনায় শুধু মাদক বহনকারী ইজিবাইক চালক, কিশোর-তরুণ, বেকার যুবকসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ ধরা পড়ে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় মাদকসেবীদের আটক করা হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মামলা দিলে সেটি তদন্ত করে পুলিশ। তবে মাদক পাচারের মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে পারে না পুলিশ।
গাংনী থানার ওসি তাজুল ইসলাম জানান, পুলিশ সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মাদক। তবে বিজিবি সহযোগিতা না করার কারণে সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালানো কষ্টকর।
৪৭ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুব মুর্শেদ রহমান জানান, মাদক নির্মূলে বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে। সীমান্তে টহল রয়েছে। মাদক নির্মূলে বিএসএফের সঙ্গেও বৈঠক হয়। পাচারকারীদের আটকের পাশাপাশি যারা মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের নজরদারীতে রাখা হয়েছে।
অভিযানের বিষয় পুলিশের সঙ্গে অসহযোগিতার ব্যাপারে তিনি জানান, সীমান্ত এলাকায় অভিযানে যে কোনো বাহিনী যাক না কেন বিজিবিকে অবহিত করা জরুরি। যেহেতু সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। তার পরও কোনো বাহিনীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হোক সেটা বিজিবি চায় না। সব বাহিনী মিলে মাদক নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই কর্মকর্তা।