পোনা উৎপাদন, পলিনেট হাউজ ও মিশ্র ফলের বাগানে কৃষকের সফলতা

প্রকাশ | ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
তিন জেলায় পোনা উৎপাদন, পলিনেট হাউজ ও মিশ্র ফলের বাগানে সফলতা পেয়েছেন তিন তরুণ উদ্যোক্তা ও কৃষক। পোনা উৎপাদনে সফল পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের স্কুলশিক্ষক চিনু মাস্টার। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বিস্ময়কর পলিনেট হাউজে ফসল চাষ করে সাড়া ফেলেছেন সবুজ নামের এক যুবক। এদিকে ইউটিউবে প্রতিবেদন দেখে অনুপ্রাণিত মিশ্র ফল বাগান করে সফল উদ্যোক্তা বগুড়ার নন্দীগ্রামের উজ্জ্বল। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরের বিস্তারিত- পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, পঞ্চগড় জেলার মাটি উঁচু এবং বেলে দোআঁশ হওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা বেশ কম। এ কারণে শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার পরই পানিশূন্য হয়ে পড়ে খাল-বিল। এরই মধ্যে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে পোনা মাছের উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়েছে। অল্প সময়ে লাভ বেশি হওয়ায় অনেকেই বড় মাছ চাষ না করে পোনামাছ চাষ শুরু করেছেন। এমন একজন পোনা মাছ চাষি হচ্ছেন উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের সোনাহার গ্রামের স্কুলশিক্ষক অশোক কুমার রায় (চিনু মাস্টার)। তিনি স্থানীয় সোনাহার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হলেও এলাকায় মাছের পোনাচাষি হিসেবে অধিক পরিচিত। অশোক কুমার রায় জানান, গত বছরের শুরুতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শার্প'র মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল আলমের পরামর্শ ও সহযোগিতায় মাছের পোনা চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরে দেড় কেজি কার্প জাতীয় মিশ্র মাছের রেণু মজুদ করে প্রায় ২০ মণ বিভিন্ন আকারের পোনা মাছ বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে বিক্রি করেছেন ১৩-১৪ লাখ টাকার পোনা মাছ। চলতি মৌসুমে তার মাছের খামারে ৪০-৪৫ মণ পোনা মাছ মজুদ রয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ২৮ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। অশোক কুমার রায়ের বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক এবং মমিনুল ইসলাম বলেন, 'পোনা বৃদ্ধি ভালো হওয়ায় আমরাও ওনার কাছ থেকে পোনা মাছ ক্রয় করে মাছচাষের জন্য পুকুরে পোনা মজুদ করেছি। আসলে অল্প সময়ে বেশি লাভের জন্য মাছের পোনা চাষ করাই উত্তম।' সেলফ-হেল্প অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন প্রোগ্রামের (শার্প) মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল আলম জানান, শার্প ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে পলস্নী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সমন্বিত কৃষি ইউনিটের (মৎস্য খাত) তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শাখায় কারিগরি ও ঋণ সহায়তার মাধ্যমে মাছচাষের টেকসই বিভিন্ন যুক্তির সম্প্রসারণ করে আসছে। অশোক কুমার রায় একজন শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও এলাকায় একজন সফল পোনা চাষি হিসেবে পরিচিত। দেবীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রতন কুমার বর্মণ বলেন, এই উপজেলায় বিভিন্ন মৌসুমি পুকুরে মাছের পোনা চাষ করার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে উপজেলায় আগের তুলনায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি শার্পসহ বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় পোনা মাছ চাষ করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, রাস্তার পাশে পলিথিন জাতীয় কাগজ দিয়ে সুন্দর একটি বড় ঘর তৈরি করা হয়েছে। এমন ঘর এ এলাকার লোকজন আগে কখনো দেখেনি। কারো চোখে পড়লেই মনে প্রশ্ন জাগে এটা কিসের ঘর! শাক সবজি চাষের জন্য এ পলিনেট হাউজ তৈরি করে সফল হয়েছেন উঠেছেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার কৃষক এখলাস উদ্দিন সবুজ নামের এক যুবক, যা দেখতে লোকজন প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন। তার বাড়ি উপজেলার পুমদি ইউনিয়নের নারায়ণ ডহর গ্রামে। কৃষক এখলাস উদ্দিন সবুজ ঢাকার কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। পড়াশোনা শেষ করে হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী। এরই ধারাবাহিকতায় মাছের রেণু থেকে পোনা উৎপাদন শুরু করেছিলেন। পরে এক কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে হয়ে উঠেছেন একজন সফল কৃষক। সম্প্রতি তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় পলিনেট হাউজ প্রদর্শনী বাস্তবায়নে পলিনেট হাউজে উচ্চমূল্য ফসল ক্যাপসিকাম আবাদ করে লক্ষাধিক টাকা আয় করেছেন। জানা গেছে, পলিনেট হাউস তৈরি করা হয় নেট, পলি এবং লোহা বা বাঁশের অবকাঠামো দিয়ে। চারপাশে নেট দিয়ে ঘেরা হয়। আর ওপরের অংশে থাকে পলিথিন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রিপল। পলিনেট হাউস তৈরি করতে প্রয়োজন তাপমাত্রা সহনশীল বিশেষ পলিথিন ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী মেশিন। এর সঙ্গে জৈব সার আর নারিকেলের ছোবড়া পচিয়ে বিশেষ উপাদান তৈরি করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি প্রয়োগে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরব্যাপী উচ্চমূল্যের ফসল ফলানো যায়। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি নিয়ন্ত্রণ, অত্যাধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর পোকার প্রবেশ রুখে দিয়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে এক আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। পলিনেট হাউসে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রকমেলন, রঙিন তরমুজ, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস ও অসময়ের সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে গ্রীষ্মকালেও ফলবে শীতকালীন সবজি। এখলাস উদ্দিন সবুজের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আধুনিক প্রযুক্তিতে মার্চিং পেপার দিয়ে টমেটো চাষ করে সাফল্য পাওয়ায় উপজেলা কৃষি অফিস তাকে পলিনেট হাউজ উপহার দেয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পে তিনি এই শেডে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করার চুক্তিবদ্ধ হন। ক্যাপসিকাম বিক্রি করে তিনি লাভবান হয়েছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম শাহজাহান কবির বলেন, পলিনেট হাউজে ফসল উৎপাদন করে তিনি সফল হয়েছেন। কৃষি অফিস থেকে সার্বক্ষণিক তাকে সহায়তা করা হচ্ছে। তাকে দেখে অন্যান্য যুবকরা কৃষিতে আসতে উৎসাহী হচ্ছেন। নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে যে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি মিশ্র ফল বাগান করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ৩নং ভাটরা ইউনয়িনের মির্জাপুর গ্রামের উজ্জ্বল আহমেদ নামে এক যুবক। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তাও। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে ইউটিউব দেখে শিক্ষা নিয়ে নিজের পরিশ্রম ও মেধায় পাঁচ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন মিশ্র ফলের বাগান। উজ্জ্বল আহমেদের সফলতার গল্প জানতে এই প্রতিবেদক ছুটে যান তার মিশ্র ফল বাগানে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় সারি সারি করে লাগানো হয়েছে হরেক রকমের মিশ্র ফলের গাছ। জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩ সালে মাস্টার্স করেন। বাড়ি থেকে তেমন একটা আর্থিক সহায়তা না পেলেও শিক্ষাজীবনে টিউশনি করেই নিজের ও পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। করোনা মহামারির সময় টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে উজ্জ্বলের চোখে পড়ে শাইখ সিরাজের মিশ্র ফল বাগান নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন। ঠিক তখনই তিনি পরিকল্পনা করেন একটি মিশ্র ফল বাগান করার। ছুটে আসেন নিজ গ্রামে, পরিবারের কাছে মিশ্র ফল বাগান করার পরিকল্পনা জানান উজ্জ্বল। কিন্তু একজন মেধাবী কলেজ পড়ুয়া ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষ করে এসে চাকরি না করে করবে ফল বাগান, উজ্জ্বলের এমন উদ্যোগকে মেনে নেননি বাবা আব্দুল খালেকসহ তার পরিবার। উজ্জ্বল পরিবার থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা না নিয়েই টিউশনি করা ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ৪০টি চায়না-৩ জাতের বারোমাসি লেবুর চারা কিনে বাড়ির পাশে পাঁচ শতক জমিতে রোপণ করেন। এরপর তিনি সন্তানের মতো গাছগুলোর পরিচর্যা করতে থাকেন। একসময় এই ৪০টা গাছ থেকে লেবু বিক্রি করে লাভবান হন। পাশাপাশি লেবুর গুটি কলম বিক্রিও শুরু করেন। এরপর আর তার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উজ্জ্বল আহমেদ যান নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখানে পরিচয় হয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইনের সঙ্গে। নাজমুল তাকে কৃষিবিষয়ক পরামর্শসহ সার-বীজ এমনকি আর্থিক সহযোগিতা দেন। তিনি কৃষি অফিসের পরামর্শে পাঁচ বিঘা জমিতে ৩ লাখ টাকা খরচ করে দার্জিলিং কমলা, ভিয়েতনামি মাল্টা, চায়না কমলা, আফ্রিকান হলুদ মাল্টা, সিডলেস লেবু, নেপালি সাগর কলা, রংবিলাস আঁখ, ফিলিপাইন বস্নাক আখ বলসুন্দরী কুলসহ প্রায় ২০ প্রজাতির ফল গাছ রোপণ করেন। এখন উজ্জ্বল আহমেদ সেসব ফলগাছ থেকে কয়েক লাখ টাকার ফল বিক্রি করছেন। পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে চারা বিক্রি করেন। পাঁচ বিঘা জমিতে তার খরচ হয় ৩ লাখ টাকা। সেখান থেকে বার্ষিক আয় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। আরও নতুন করে পাঁচ বিঘা জমিতে ফিলিপাইন বস্নাক আঁখ, নেপালি সাগর কলা ও নার্সারি করার জন্য জায়গা প্রস্তুতি চলছে। উজ্জ্বল আহমেদের ফার্মের নাম স্বপ্ন অংকুর অ্যাগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নার্সারি। তার নার্সারিতে রয়েছে প্রায় দেড়শ' প্রজাতির ফলের চারা। তিনি এখন হয়েছেন বড় মাপের একজন কৃষি উদ্যোক্তা। তার নার্সারির ফলের চারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল বলেন, 'উজ্জ্বল আহমেদ আমার দেখা একজন পরিশ্রমী কৃষি উদ্যোক্তা। আমি শুরু থেকে তাকে মিশ্র ফল বাগান করার জন্য সব ধরনের পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছি এবং সবসময় তার মিশ্র ফল বাগানে পরিদর্শন করি।' এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গাজীউল জানান, 'আমার নন্দীগ্রামে যদি কোনো কৃষি উদ্যোক্তা থেকে থাকে সেটি হচ্ছেন উজ্জ্বল আহমেদ। তিনি অনেক পরিশ্রম করে আজ একজন বড় কৃষি উদ্যোক্তা হয়েছেন। কৃষি অফিস থেকে তাকে সব ধরনের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে, আমরা সবসময় তার পাশে রয়েছি।'