বাড়িঘর লুটপাট, শতাধিক মামলা
ভৈরবের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ৫৬ বছরে ১২ খুন
প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মৌটুপি গ্রামে কর্তা আর সরকার বাড়ির আধিপত্য বিস্তার ও শত্রম্নতায় পিতা কফিল উদ্দিনের মতো খুন হয়েছেন নাদিম মিয়া (৫৫)। বাপ-ছেলে দুইজনই কর্তা বাড়ির বংশধর। ঈদের আগের দিন কর্তা বাড়ি ও সরকার বাড়ির লোকজনের মধ্য সংঘর্ষ বাঁধলে নাদিম গুরুতর আহত হন। গত ১৯ জুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। গত বৃহস্পতিবার সকালে তার নামাজে জানাজা শেষে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় তাকে দাফন করা হয়। তার মৃতু্যর খবরে প্রতিপক্ষ সরকার বাড়ির গোষ্ঠীর শতাধিক পরিবার মামলা ও পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে নিহত নাদিমের লাশ দাফন শেষ করার পর কর্তা বাড়ির গোষ্ঠীর লোকজন সরকার বাড়ি ফাঁকা পেয়ে কমপক্ষে শতাধিক ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ১৯৬৮ সালে কর্তা বাড়ির রইছ উদ্দিন সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে মারা যান। এরপর থেকে অদ্যাবধি চলছে ঝগড়া-বিবাদ আর খুন। এর ধারাবাহিকতায় পিতা কফিল উদ্দিনের মতো প্রাণ হারান নাদিম। অন্যদিকে সরকার বাড়ির নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুবকর সিদ্দিকের দুই ছেলের মধ্যে ১৯৮৫ সালে হেদায়েত উলস্নাহ ও ২০০৫ সালে ছোট ছেলে ওবাইদুলস্নাহ কর্তা বাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় খুন হয়।
বংশ পরম্পরায় শত্রম্নতায় ৫৬ বছরে মৌটুপি গ্রামে দুই বংশেরসহ মোট ১২ জন খুন হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানায়। ঝগড়া সংঘর্ষে আহত ও মামলা হয়েছে শতাধিক, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে কয়েকশ'। বর্তমানে দুই বংশের একাধিক ব্যক্তি খুনের মামলার আসামি হয়েছেন। কর্তা বাড়ির সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক ও সরকার বাড়ির বর্তমান চেয়ারম্যান সাফায়েত উলস্নাহ আসামি হয়ে উভয়পক্ষ মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। যুগ যুগ ধরে মামলা চলছে, আর আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন তারা।
সূত্র মতে, এখনো দুই পক্ষের বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আছে প্রায় ৫শ' লোক। সংঘর্ষ বাঁধলে উভয়পক্ষ একে অপরের বাড়িঘর লুটপাট, ভাংচুর করে। যে পক্ষ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতারা একাধিকবার বসেও বিরোধ মীমাংসা করতে পারেনি। বংশীয় শত্রম্নতা ও গ্রামের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ৫৬ বছর যাবত দুই বংশের ঝগড়া আর শত্রম্নতা চলছেই।
বর্তমানে সরকার বাড়ির নেতৃত্বে আছেন বর্তমান সাদেকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাফায়েত উলস্নাহ। তার বাবা সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আবুবকর সিদ্দিক জীবিত থাকাকালে তিনি এই বংশের নেতৃত্ব দিতেন। তিনি তিনবারের ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তার ছেলে সাফায়েত দুইবারের ইউপি চেয়ারম্যান। তারা বাপ-ছেলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবুবকর জীবিত থাকতে দীর্ঘদিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
কর্তা বাড়ির নেতা ও নিহত নাদিমের ভাই বাকি কর্তা বলেন, 'তুচ্ছ ঘটনায় তারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এর আগে আমার বাবা ও চাচাকে খুন করে। নাদিমকে হত্যার ঘটনায় উত্তেজিত লোকজন তাদের বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট করেছে সত্যি, তবে আমরা বাধা দিয়েছি, কয়জনকে আটকে রাখব। যুগ যুগ ধরে সরকার বাড়ির লোকজন আমাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, খুন করছে। এর শেষ কোথায় আমরা জানি না।'
অন্যদিকে সরকার বাড়ির নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান সাফায়েত উলস্নাহর ছোট বোন তাসলিমা আক্তার বলেন, 'নিহত নাদিম সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় আহত হলেও তাকে প্রথমে হাসপাতালে চিকিৎসা না করে বাসায় চিকিৎসা করেছে। পরে অবস্থা গুরুতর হলে তাকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর সেখানে নাদিম মারা যান। এখন আবার আমাদের শত পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট করেছে। কর্তা বাড়ির লোকজন আমার দুই ভাইকে হত্যা করেছে।'
ঘটনার পর গত শনিবার বিকালে নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর ও ভৈরব পৌর মেয়র ইফতেখার হোসেন বেনু গ্রামটি পরিদর্শন করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সেন্টুসহ দলীয় নেতারা নাদিমের নামাজে জানাজায় অংশ নিয়ে উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও তাদের কথা কেউ শুনছে না। চেয়ারম্যান আবুল মনসুর ও পৌর মেয়র বেনু বলেন, 'আমরা গ্রামটি পরিদর্শন করে দুই পক্ষকে অনুরোধ করেছি শান্ত থাকতে। খুনের ঘটনা আইন অনুযায়ী চলবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ভাংচুর ও লুটপাট দুঃখজনক।' তারা অচিরের দুই পক্ষকে নিয়ে স্থায়ী সমাধানে চেষ্টা করবেন।
ভৈরব থানার ওসি সফিকুল ইসলাম জানান, মৌটুপি গ্রামের মানুষ বংশ পরম্পরায় শত্রম্নতা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুগ যুগ ধরে ঝগড়া সংঘর্ষ করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটালে পুলিশ কাউকে ছাড় দেবে না। গ্রামে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এ গ্রামের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সমাজপতিদেরও এগিয়ে আসা উচিত।