রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বাড়ছে খুন
প্রকাশ | ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে হত্যাকান্ড থামছেই না। অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটেছে মিয়ানমারের দু'টি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগির জের ধরে। ওই দু'টি প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী ছাড়াও আরও ১০ থেকে ১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী আশ্রয়শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে চলছে। এদের হাতে চলতি বছরের পাঁচ মাসে (জুন ১২ তারিখ পর্যন্ত) খুন হয়েছেন ৩৭ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে গত মে মাসের প্রথমার্ধেই খুন হন ১৭ জন। এছাড়া সাড়ে ছয় বছরের বেশি সময়ে খুন হয়েছেন ২২৬ জন। কক্সবাজার পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১২ জুন আরসার এক সন্ত্রাসী নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এর আগে ১০ জুন উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিন রোহিঙ্গা নিহত হন। মিয়ানমারের আরসা এ হামলা চালায়। নিহতরা মিয়ানমারের আরএসও'র সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতেও সশস্ত্র আরসাই এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যত দিন গড়াচ্ছে ততই আশ্রয়শিবির ঘিরে বেপরোয়া হয়ে উঠছে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হলেও থামছে না তাদের অপতৎপরতা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এরা আশ্রয়শিবিরে মজুত করছে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই আসছে মিয়ানমার থেকে।
আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবাল জানান, সর্বশেষ ১০ জুন তিনজন খুনের ঘটনার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী মৌলভী আকিজসহ পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করের্ যাব। এ সময় কয়েকটি বন্দুক, গুলি ও কিছু পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়।
র্
যাব ১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'একটি-দু'টি নয়, একে একে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে '৩০ খুনে' জড়িত আরসার শীর্ষ এই নেতা মৌলভী আকিজ। তিনি প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুলস্নাহ হত্যা থেকে শুরু করে সেভেন মার্ডার, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হত্যা ও হেড মাঝি, সাব মাঝিসহ একাধিক রোহিঙ্গা হত্যায় জড়িত। তার বিরুদ্ধে ২১টিরও বেশি মামলা রয়েছে।'
এর আগে গত ১৫ মে উখিয়ার গহিন পাহাড়ের্ যাবের অভিযানে আরসার আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড ও রকেট সেল উদ্ধার শেষের্ যাব জানায়, আরসার হাত দিয়ে ভারী অস্ত্র ঢুকছে দেশে। অভিযানে জব্দ অস্ত্রের মধ্যে একাধিক 'মিলিটারি আর্মস' বা 'আর্জেস ও রাইফেল গ্রেনেড' রয়েছে, যা সাধারণত যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। অপরাধীদের হাতে এমন ভারী অস্ত্র যাওয়া উদ্বেগের।
র্
যাবের ওই অভিযানের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের আনাগোনার চর্চিত বিষয়টিও ফের আলোচনায় আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং আতঙ্কের।
২০১৭ সালে এ দেশে আশ্রয়ের পর থেকেই রোহিঙ্গারা বাড়তি বোঝা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি বারবার উঠলেও এর কোনোই সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় খুনাখুনি ছাড়াও মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসহ খুনাখুনি বাড়ায় মাঝে মধ্যে যৌথ অভিযানও চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হলেও সুফল অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে, আশ্রয়ের ছয় বছরের বেশি সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আড়াই শতাধিক হত্যাকান্ড ঘটেছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিপর্যয় ঘটেছে পরিবেশের। এ কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে পাহাড় ধসের ঘটনাও।
গত ১৫ মে অস্ত্র উদ্ধারের পর র?্যাব ১৫-এর অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, 'এমন কিছু অস্ত্র আমরা পেয়েছি, যেগুলো সাধারণত মিলিটারি আর্মস হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে আর্জেস ও রাইফেল গ্রেনেড আছে। এমন গ্রেনেড অপরাধীদের হাতে যাওয়া উদ্বেগজনক।'
কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে আরসা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে জানিয়ে ঢাকায়র্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম ১৭ মে সাংবাদিকদের বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্ক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা। তারা অপহরণ, লুণ্ঠন, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। এর আগে নানা অভিযানে এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিপুল বিস্ফোরক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।র্ যাবের অব্যাহত নজরদারি ও তৎপরতায় আরসা নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে পাশের দেশের অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনায় আমাদের দেশে অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রবেশ করছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই ১৫ মে লাল পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ দু'জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এ তৎপরতা নিষ্ক্রিয় করার জন্য স্থানীয় থানাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে, যখনই তথ্য পাচ্ছি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।'
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালের এখন পর্যন্ত ৩৪ জন নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। দুই বছরে গ্রেপ্তার হয়েছেন আরসার ১১২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। এছাড়া উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৫২ কেজি বিস্ফোরক, ৫টি গ্রেনেড, ৩টি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় তৈরি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৪টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১৬৮ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ৪টি আইডি ও ৪৮টি ককটেল।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ক্যাম্পে অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক চোরাচালানিদের নেটওয়ার্ক থাকতে পারে। তারাই মিয়ানমার সীমান্ত পার করে অস্ত্রের চালান আনছে। রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দারা জানান, কক্সবাজারের ৩২টি ক্যাম্পে মাদক, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে তুচ্ছ ঘটনায় এখন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, 'ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়েছে। তাই হত্যাকান্ডও বেড়েছে।'
বর্তমানে কক্সবাজারের সব ক্যাম্পেই অপরাধমূলক কাজকর্ম চলছে। রোহিঙ্গারা দলগত সশস্ত্র তৎপরতা, মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে বেড়েই চলেছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের আনাগোনার বিষয়টিও বিশেষভাবে চর্চিত- এমন অভিযোগ উঠছে। এমনকি একাধিক মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, আরসা সশস্ত্র গোষ্ঠীটি হারাকাহ আল ইয়াকিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আরসার প্রতিষ্ঠাতা আতাউলস্নাহ আবু আম্মার জুনজুনি এলিয়াস হাফিজ তোহার জন্ম পাকিস্তানে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর ইত্যাদি মৌলবাদী সংগঠনের।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বহুদিন আগেই বলেছিলেন, 'পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সবসময় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক কাজ করে থাকে। আরসা প্রধান আতাউলস্নাহ পাকিস্তানি হওয়ায় এ এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিশেষ সহায়ক। আইএসআই তাদের অস্ত্র ও অর্থ দুটোই সরবরাহ করছে।' পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বাড়ানোর পরামর্শ এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বহুদিন আগে স্বীকার করেন, 'রোহিঙ্গারা দিন দিন বিষফোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি'।