ঈদে ব্যস্ততা বাড়লেও ক্রেতা সংকটে কামারশিল্পীরা

আয় কম থাকায় সরকারি সহায়তার দাবি

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌর এলাকায় টুং টাং শব্দে দা-বঁটি তৈরি করছেন কামার শিল্পী -যাযাদি
পবিত্র ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন হাট-বাজারের স্থায়ী ও মৌসুমি কামার শিল্পীরা। পশুর মাংস কাটতে দা, বঁটি, ছুরি, ধামা, চাপাতিসহ বিভিন্ন ধাতব লোহা ও স্টীলের হাতিয়ারের ব্যবহার অপরিহার্য। তবে প্রতিবছর এসব জিনিস কিনেন না ক্রেতারা, পুরনো জিনিস শান দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। তাই ক্রেতা সংকট দেখা দেখে অনেক এলাকায়। কোরবানিতে বিক্রি বাড়লেও বছরের ১১ মাস বিক্রি খুবই কম হয়। তাই সরকারি সহায়তার দাবি করছেন অনেক কামারশিল্পীরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত খবর- সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, পবিত্র ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারের স্থায়ী ও মৌসুমি কামার শিল্পীরা। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে কামার শিল্পীদের ব্যস্ততা। কোরবানির ঈদে গরু, ছাগল, মহিষসহ বিভিন্ন গবাদিপশু জবাই করা হয়। ঈদের দিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পশু জবাই। এসব পশুর মাংস কাটতে দা, বঁটি, ছুরি, ধামা, চাপাতিসহ বিভিন্ন ধাতব লোহা ও স্টীলের হাতিয়ারের ব্যবহার অপরিহার্য। তাই কামাররা এখন ধাতব লোহা ও স্টিলের হাতিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা যায়, মির্জাখীল বাজারের কামাররা দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কয়লার চুলায় জ্বলন্ত আগুনে গরম লোহার পিটাপিটির ফলে সৃষ্ট টুংটাং শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে প্রতিটা কামারের দোকান। দম ফেলারও যেন সময় নেই কামার শিল্পীদের। রাতদিন ভুলে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। আগে যেসব দোকানে দু'একজন করে শ্রমিক কাজ করতেন, এখন সেসব দোকানে ৩-৪ জন শ্রমিক কাজ করছেন। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কয়েকগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় এসব কামার শিল্পীদের। স্থানীয় কয়েকজন কামারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পশুর চামড়া ছাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত ছুরি ১৫০-২৫০ টাকা, দা ৫০০-৮০০ টাকা, বঁটি ৪০০-৫৫০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৮০০-১২০০ টাকা ও চাপাতি ৮০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে এসব সরঞ্জামের দাম নির্ধারণ করা হয় বলে জানান তারা। কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কামাররা দা, বঁটি, চাপাতি ও ছুরির দাম বেশি হাঁকাচ্ছেন। ব্যবহৃত ছুরি শান দেওয়ার জন্য কাজের গুণগতমানের ওপর ভিত্তি করে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন অনেকে। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বাড়তি দাম দিয়ে এসব সরঞ্জামাদি কিনতে হচ্ছে। অপরদিকে কামাররা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, কোরবানির ঈদকে পুঁজি করে কয়লা ও ধাতব লোহার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে অধিক দাম দিয়ে এসব সরঞ্জাম কিনতে হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাড়তি শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ অর্থ উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের বোমাংহাটের পুষ্প কর্মকার বলেন, 'কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এখন কাজের চাপ একটু বেশি। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে আমাদের কাজের চাপ ও বিক্রি ততই বাড়ছে। তবে ধাতব লোহা ও কয়লার দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের মন জয় করতে একটু সমস্যা হচ্ছে।' মির্জাখীল বাজারে কামারের দোকানে ছুরি ও দা বানাতে আসা আবদুল কাদের জানান, 'আর একদিন পর কোরবানি ঈদ। তাই ছুরি ও দা বানাতে কামারের দোকানে এসেছি। আগে একটি দা কিনতাম ৩০০-৪০০ টাকা। একই দা এখন নিজের লোহা দিয়ে বানিয়ে নিতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫০০ টাকা।' সাতকানিয়া সদর বনিক সমিতির সভাপতি গোলাম ফেরদৌস রুবেল বলেন, কামার শিল্পীদের ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়েছে। ঈদের আগে দা, ছুরি, বঁটি ও চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিতে কামাররা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ধাতব লোহার দাম যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি কামারের দোকানে নিয়োজিত মৌসুমি শ্রমিকদের মজুরিও বেশি গুনতে হচ্ছে। এসব খরচ পুষিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তৈরি করতে এবং শান দিতে তারা দাম একটু বেশি হাঁকাচ্ছেন। ফুসরত ফেলার দম নেই কর্মকারদের হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, পবিত্র ঈদুল আজহায় সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, মহিষ, গয়াল, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কেউবা উট কিনছেন কোরবানি দেওয়ার নিয়তে। কোরবানির পশু ক্রয়ের পাশাপাশি থাকে দা-বঁটি, ছুরি, চাপাতি, কিরিচ ক্রয় করা। তবে প্রতিবছর কোরবানি এলেই সবাই তা কেনেন না। এক মৌসুমে কেনা পশুর চামড়া আলাদা করতে ও মাংস কাটতে এসব সরঞ্জাম কিনলেও অন্য বছর শান (ধার) দিয়ে চালিয়ে দেন। জিলক্বদ মাসের চাঁদ উদিত হলেই ছুটে যান কর্মকারের দোকানে। কোরবানিদাতা এবং যারা সামর্থ্য না থাকায় দিতে পারেন না তারাও সমানতালে ছুটেন কর্মকারের দোকানে। কারণ নিজে দিতে না পারলেও আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের দেওয়া গোশত কাটতে এসবের প্রয়োজন হয়। ফলে দা-বঁটি, ছুরি সবারই প্রয়োজন হয় পবিত্র কোরবান মৌসুমে। আর শেষের দিনে কর্মকারের দোকানগুলোতে দম ফেলার ফুসরত নেই কর্মকারদের। নির্ঘুম চোখে দিনরাত টুংটাং শব্দে চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ। বছরের এগার মাস কোনোমতে এ পেশা ধরে রাখলেও এ মৌসুমের আশায় থাকেন তারা। মৌসুমের ব্যবসাই যেন এগার মাসের কস্ট টেনে দেবে। কিন্তু এখন তা আগের মতো হয় না বলে জানান কর্মকাররা। বুকভরা আশা নিয়ে দা-বঁটি শানের অর্ডার কিংবা বিক্রি করলেও তেমন লাভবান হতে পারেন না। কারণ হিসেবে উলেস্নখ করেন মৌসুমি ব্যবসায়ী। হাটহাজারী পৌর সদরের কাজল কর্মকার (৫৭) বলেন, 'বাপ-দাদার পেশা এখনো ধরে রেখেছি। অন্য কাজ না জানায় ছেড়ে যেতেও পারছি না। সারাবছর ধার-দেনা করে এ পেশা টিকিয়ে রাখি কোরবানির আশায়। কাস্টমারের কমতি নেই কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণে আগের মতো লাভবান হতে পারছি না। কোনোমতে খরচটা ওঠে। যারা অন্য পেশায় জড়িত তারাও লোহার ব্যবসা তথা দা-বটি বিক্রির ব্যবসায় নেমে পড়ছে। একজন কর্মকারের কত টাকা খরচ পড়ে তা তৈরি করতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানে না। অতিরিক্ত লোকের বেতন, উচ্চ মূল্যে কয়লা ক্রয় আরও কত কি।' পার্থ কর্মকার বলেন, 'যাদের লাইসেন্সে যে ব্যবসার কথা উলেস্নখ আছে সেটা না করে মৌসুমে অন্য পেশার ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি করছে তা প্রশাসনের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমাদের লাইসেন্সে কর্মকার লেখা আছে আমি কীভাবে অন্য ব্যবসা করব এটা কি দেখা উচিত নয়।' উপজেলার বিভিন্ন কর্মকার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দা-বঁটি, ছুরি, চাপাতি, কিরিচের মূল্য গতবারের মতোই রয়েছে। যদিও মানুষের বেতন, কয়লার দাম বেড়েছে। ছোট ছুরি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে মাঝারি ও বড় বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। বটি ১৫০ থেকে শুরু করে ২৮০ টাকা। এ ছাড়া কিরিচ ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা। তবে দোকানে দোকানে ছোট বড় চাপাতির দেখা মিললেও এ বছর এর চাহিদা নেই বললেই চলে বলে জানান তারা। অপরদিকে রুটি পরটা তৈরি করার পিড়ি-বেলুন, ডিজিটাল রুটি মেকার, লোহার তাওয়া, গোশত কাটায় ব্যবহৃত তেতুল গাছের টুকরো বিক্রির দোকানে বেচাকেনা চলছে। এসব দোকানে পুরুষের চেয়ে মহিলা ক্রেতার সংখ্যা চোখে পরার মতো। লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, কোরবানির ঈদকে উদ্দেশ্য করে ব্যস্ততা বেড়েছে কামারদের। দিনরাত চাপাতি, ছুরি আর দা-বটি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামাররা। লোহা, কয়লা এবং মজুরের দাম বাড়ায় এবার বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে কোরবানির পশু কাটার প্রতিটি সরঞ্জাম। টুংটাং শব্দে কয়লার গন্ধে মুখর কামারি দোকান। ব্যস্ততা বেড়েছে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার বিভিন্ন বাজারে পশু কাটার সরঞ্জামের দোকানে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চাপাতি, ছুরি দা-বটির দোকানে বেড়েছে কর্মব্যস্ততা। মান বেঁধে নতুন চাপাতি কিনলে গুনতে হবে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। স্থানীয় ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার দা-বটি ধার করতে দ্বিগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর নতুন কিনলে তো কথাই নেই, যেন আকাশ ছোঁয়া দাম! এদিকে উপজেলার মাইনী বাজারের কয়েকজন কামার জানান, পুরনো জিনিস সান দেই নতুন জিনিস কিনে রেডি রাখতে হয় পশু জবাইয়ের জন্য। বড় ছুরি ৫০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, না হয় লোকসান গুনতে হয়। তবে দাম নিয়ে অভিযোগ ক্রেতাদের। বিক্রেতারা বলছে লোহার দাম বেড়েছে মজুরি দিতে হচ্ছে বাড়তি। তাই আগের চেয়ে তুলনামূলক সবকিছুর দাম বেড়েছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পশু কাটার সরঞ্জামের বিক্রি বাড়বে। কেনাবেচা চলবে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। তবে লাভ কম হওয়ার ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দায়। তাই সরকারি সহায়তা চান কামাররা। এ বিষয়ে মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল বলেন, 'প্রাচীন আর দুর্লব এ পেশার মানুষগুলো সত্যিই অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছে। দেশ আধুনিক হওয়ায় তাদের কাজের চাহিদা কমেছে বহুগুণ। তবুও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের জন্য যে কোনো সুযোগ-সুবিধা বা সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করব।' উপজেলা সমাজসেবা সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কামারদের জরিপ করে তথ্য নেওয়া হয়েছে, সরকার বরাদ্দ দিলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাদের দেওয়া একাউন্ট নাম্বারে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জয়াস চাকমার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি এবং মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল দিয়েও সংযোগ মেলেনি।