আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে দেশের কামারপাড়াগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। বছরের অধিকাংশ সময়ে কামার পাড়ার হাতুরির টুং টাং শব্দ খুব একটা শোনা না গেলেও প্রতি বছরে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে টুং টাং শব্দে তাদের উপস্থিতি জানান দেন কামার সম্প্রদায়। তবে প্রযুক্তির আবিষ্কার ও পশু কাটার রেডিমেট সরঞ্জামের সহজলভ্যতায় কমে গেছে কামার পাড়ার আগের সেই ব্যস্ততা। অনেকেই তাদের বাপ-দাদার এ ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আঞ্চলিক স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
স্টাফ রিপোর্টার, মাদারীপুর জানান, আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন মাদারীপুরের কামাররা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চাপাতি, দা, ছুরি, বটিসহ পশু কাটার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কামারপাড়া ঘুরে জানা গেছে, জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রায় দুই শতাধিক কামারের দোকান রয়েছে। মাস খানেক আগে কামাররা অলস সময় পার করেছে। কোরবানিকে সামনে রেখে গত এক সপ্তাহ ধরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কামারপাড়া। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নতুন চাপাতি, দা, ছুরি, বটিসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করছে। নতুন চাপাতি, দা, ছুটি ছয়শত টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করছে। পুরাতন চাপাতি, দা, ছুরি পঞ্চাশ টাকা থেকে একশত টাকা করে ধার দিয়ে দিচ্ছে।
কামার সুশীল বলেন, 'আমার বাবা-দাদারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমি কাজ করছি প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে। এ পেশাটা একটা ভালোবাসার খোরাক হয়ে আছে। মন চাইলেও যেন ছাড়তে পারছি না। সারা বছর টুকটাক কাজ কর্ম হয়। কোরবানি আসলে কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়। এ বছর ভালোই ব্যস্ততায় সময় পার করছি। সরকারিভাবে যদি কোন ধরনের সহযোগিতা পাই তা হলে ব্যবসাকে আরও বড় করতে পারতাম।'
মনোরঞ্জন নামে আরেক কামার বলেন, 'আমি ছোট বেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত। সারা বছর বেশি বেচাকেনা হয় না। কোরবানি আসলেই বেচাকেনায় চাপ বেড়ে যায়। নতুন দা, চাপাতি বিক্রি করছি ছয়শত টাকা কেজি দরে। আর পুরাতনগুলো পঞ্চাশ থেকে একশত টাকায় ধার দিয়ে দেই।'
দা, চাপাতি ক্রয় করতে আসা কয়েকজন ক্রেতা জানান, এ বছর গরু কেনার আগেই দা, ছুরি কিনতে এসেছি। এখন দাম কিছুটা কম আছে। দুই, তিন দিন পরে দাম অনেক বেড়ে যাবে। কামারপাড়ায় এসে দেখলাম দা, ছুরি কেনার জন্য অনেক মানুষের ভিড়।
আরেক ক্রেতা বলেন, কোরবানির পশু জবাই করার জন্য আমার কাছে গত বছরের চাপাতি, দা, ছুরি আছে। আমি পুরাতনগুলোই ধার দিয়ে নিয়ে গেলাম। পুরাতনগুলো দিয়েই এ বছর মাংস কাটব।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ বলেন, 'ইতিমধ্যে কামারদের জন্য সদর উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এ ছাড়াও কামার এবং তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আমাদের উদ্যোগ আছে। জীবন মানের উন্নয়নের জন্য ওনারা যদি আগ্রহী হয়ে থাকে তা হলে আলোচনার মাধ্যমে আমরা তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা প্রদান করব।'
চৌদ্দগ্রাম (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, সারাদেশের ন্যায় কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রামে কামারপাড়ায় চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। পুরো বছর কামারের প্রয়োজন না হলেও ঈদুল আজহায় প্রায় অধিকাংশেরই কামারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এসময় চাহিদা অনুযায়ী মানুষের দা, বটি, ছুরি শান দেওয়া ও নতুন তৈরিতে যেন দমফেলার সুযোগ নেই তাদের। এ সময় রুটি, রুজি বেশি হওয়ায় কামার ও কারিগরদের মনেও ব্যাপক আনন্দ থাকে। হাতুরি পেটানো আর হাপরে বাতাস দিয়ে আগুনের কাছে বসে থাকা অনেক কষ্ট সাধ্য হলেও পণ্য অধিক দামে বিক্রি করতে পারলে অনেকটা দূর হয়ে যায় তাদের কষ্ট। কোরবানির আবশ্যকীয় আইটেম হওয়ায় সাধারণ মানুষ ছুটছেন কামারদের কাছে। তবে নতুন ছুরি ও অন্যান্য কোরবানির সরঞ্জামের দাম বেশি হওয়ায় ঘরে থাকা পুরনোগুলোতেই শান দিচ্ছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে পুরনোগুলোতে শান দেওয়াতেও গত বছরের তুলনায় বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
তবে চৌদ্দগ্রাম বাজারের একাধিক কামার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেডিমেট তৈরি দা, বটি, ছুরি সহজলভ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের কাছে বছরের অন্যান্য সময়ে খুব একটা আসে না। ফলে বছরের ১১টি মাসই তাদেরকে লস হয়। ফলে ইতোমধ্যেই চৌদ্দগ্রামের অনেক কামার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
বিশেষ করে চৌদ্দগ্রাম বাজারের ওয়াপদা সড়ক এক সময় সারি সারি কামার দোকান থাকলেও কালের বিবর্তনে এবং বছরের অন্যান্য সময় কাজ না থাকায় এখন মাত্রা দুই-তিনটি দোকান দেখা যায়। অল্প সংখ্যক দোকান হওয়ায় এসব দোকানে সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেক দোকানে সময়মতো সরঞ্জাম না দিতে পারার ঘটনাও ঘটছে। উপজেলার গুনবতী, ধোড়করা, গুনবতী, আমানগন্ডা, মুন্সিরহাট, কাশিনগর, বাবুর্চিবাজার, মিয়াবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতেও কামার ও কারিগরদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো।
চৌদ্দগ্রাম বাজারের কামারপাড়ার কারিগর রতন কর্মকার জানান, পর্যাপ্ত কাজ না থাকায় বছরের অধিকাংশ সময় বসে থাকতে হয়। তা ছাড়া বর্তমানে কয়লা এবং লোহার দামও বেশি। তাই কোরবানির ঈদেই দা, বটি এবং ছুরি শানের রেটও একটু বেশি থাকে। তিনি আরও জানান, বছরের অন্যান্য সময় কাজ না থাকায় কামাররা অন্যান্য পেশায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এতে করে কামার পেশাই এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
\হবাজারের আরেক কারিগর মরণ কর্মকার জানান, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে বিভিন্ন হার্ডওয়ার দোকানে দা-বটি, ছুরিসহ সব কিছু পাওয়া যায়। আগের মতো মানুষ আমাদের কাছে আসে না। ফলে বছরের পুরো সময়ই বসে থাকতে হয়। কোরবানির ঈদে পাঁচ-সাত দিন কাজ করে কি আর সংসার চালানো কষ্টকর। ফলে অনেকের মতো হয়তো আমিও বাপ-দাদার এ ব্যবসা ছেড়ে দেব।
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, আর মাত্র দুদিন বাকি ঈদুল আজহার। তাই পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কামার শিল্পীরা। ভোর হতে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কামার পলস্নীগুলোতে ব্যস্ততার চিত্র দেখা যায়। কোরবানির পশুর মাংস কাটাকাটি আর চামড়া ছাড়ানোর জন্য অন্যতম অনুষঙ্গ দা, ছুরি, চাপাতি, বটিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে তারা।
ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে কামার শিল্পীদের কাছে গরু কাটার দা, চাপাতি, ছুরিসহ নানা জিনিস কিনছেন। আবার অনেকে ঘরে থাকা পুরনো দা, ছুরি, চাপাতি ধার করাতে আসছেন। সারা বছর তৈরিকৃত এসব পণ্য যত বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদুল আজহা উপলক্ষে। কারণ, পশু জবাহ করার জন্য ধারালো অস্ত্রের প্রয়োজন। আর ঈদ চলে যাওয়ার পর এসব অস্ত্র সবাই সংরক্ষণ করে রাখেন। সেগুলোতে মরিচা পড়ে যায়। তাই প্রতি বছর নতুন নতুন অস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। আর সে কারণেই ঈদকে কেন্দ্র করে দা, ছুরি, চাপাতি বটিসহ নানা পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কামার শিল্পীরা।
নন্দীগ্রাম পৌর এলাকার বাজারসংলগ্ন বিদু্যৎ কর্মকার জানান, বর্তমানে কোরবানির কাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রের মধ্যে নতুন বটি প্রকারভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, দা এক হাজার থেকে ১২শ' টাকা, ৮ ইঞ্চি থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত মজুরি, ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, ১২ ইঞ্চি থেকে ১৫ ইঞ্চি এক হাজার এবং ছোট আকৃতির ছুরি ৫০ থেকে দেড়শ' টাকা দামে বিক্রয় হচ্ছে।
পুরাতন বাজারের কর্মকার রবি চন্দ্র জানান, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর এসব জিনিসের বিক্রি কম হওয়ায় বিপাকে পড়েছি। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কোরবানির সময়টায় আমাদের কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় আয় রোজগারও।'
ওমরপুর হাটের শাহীন কর্মকার জানান, কামার শিল্পের অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি হচ্ছে কয়লা, কিন্তু এই কয়লা এখন আর তেমন পাওয়া যায় না, গ্রামে ঘুরে ঘুরে এই কয়লা সংগ্রহ করতে হয়। এই কয়লার অপ্রতুলতায় দাম অনেক বেড়ে গেছে বেড়েছে লোহার দামও। লোহা ও কয়লার দাম বাড়লেও সে অনুসারে কামার শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি।
ইসবপুরের স্বদেব কর্মকার জানান, ঈদ উপলক্ষে এক মাস কাজের চাপ থাকলেও পরবর্তী ১১ মাস তেমন কোনো কাজ হয় না। এর কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে পৈর্তৃক এ পেশা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া অন্য সময়ে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা রোজগার করেও সংসার চালানো কষ্ট সাধ্য হয়। সরকার মৎস্য আহরণকারী জেলেদের সাহায্য প্রদান করলেও আমাদের এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই আমরা শিল্পীদের সরকারি সাহায্য বা অনুদানের দাবি জানাচ্ছি।