কোরবানির পশুর হাট জমে উঠলেও ক্রেতা সংকট
প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার আর মাত্র দুইদিন বাকি রয়েছে। ইতোমধ্যে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। তবে হাটগুলো ক্রেতা সংকটে ভুগছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
স্টাফ রিপোর্টার, পিরোজপুর জানান, ক্রেতা সংকটে ভুগছে পিরোজপুরের কোরবানির পশুর হাটগুলো। হাটভর্তি লোক থাকলেও নেই ক্রেতা। দাম করে চলে যাচ্ছেন অনেকে। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে পশুর হাটগুলো জমতে শুরু করেছে। তবে কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা ও দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ বিক্রেতাদের। এমন চিত্র দেখা গেছে জেলার নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান স্থায়ী পশুর হাট ঘুরে।
দীঘিরজান হাটে ঘুরে দেখা যায়, পিরোজপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী ও খামারিরা। কোরবানির গরুতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে পুরো পশুর হাট। ছোট-বড় সব ধরনের কোরবানির পশুর পশরা সাজিয়ে ক্রেতাদের অপেক্ষায় বসে আছেন বিক্রেতারা। তবে ক্রেতা মিলছে না। বিশেষ করে আশপাশের জেলা থেকে ব্যাপারীরা ট্রাক, নসিমনে করে একসঙ্গে ৫ থেকে ১০টি বা তার অধিক গরু নিয়ে এসেছেন। হাটের অবস্থা এমন থাকলে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। বিক্রেতারা বলছেন, পশু বেশি আসলেও হাটে ক্রেতার বেশ সংকট। অতিরিক্ত গরম এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে এমনটা হতে পারে। পশু দেখে অনেক কম দাম বলে চলে যাচ্ছেন ক্রেতারা। তাদের গরু কেনার আগ্রহ কম। বিক্রি না হলে অন্য হাটে বা খামারে ফেরত নিয়ে যেতে হবে। ফলে পরিবহণ খরচও বেড়ে যাবে।
পিরোজপুর সদর উপজেলার ব্যাপারী রহমান শেখ বলেন, তিনি এ বছর কোরবানির জন্য ২৫টি গরু কিনেছেন। এই হাটে ১৫টি গরু নিয়ে এসেছেন। এখনো গরু বিক্রি করতে পারিনি। এ হাটে ক্রেতা অনেক কম। ক্রেতারা আমার প্রত্যেকটা গরুর দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা কম বলছেন। এই দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে। স্থানীয় মাটিভাঙ্গা গ্রাম থেকে এসেছেন খামারি বেলায়েত হোসেন, '৪টি গরু নিয়ে এসেছি তবে দাম পাচ্ছি না। যে দাম বলে তাতে গরু দিয়ে দিলে লস হবে। এই হাটে গরু বেশি, কিন্তু ক্রেতা কম। সবাই দেখতে এসেছে।' কোরবানির পশু কিনতে আসা ক্রেতা হাসান মামুন বলেন, 'নাজিরপুরের দীঘিরজান হাটে গরু কেনার জন্য এসেছি। হাটে প্রচুর গরু উঠেছে। ছোট-বড় সব ধরনের গরু আছে তবে দাম কিছুটা বেশি। একটি গরু পছন্দ হয়েছে দাম দরে মিললে কিনে ফেলব।'
হাটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাজিরপুর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. সোলায়মান বলেন, 'হাটের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে আমার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এবং গ্রামপুলিশ সদস্যরা আছেন। জাল টাকা চেক করার মেশিন আছে। আশা করি আমরা এখানে সুষ্ঠুভাবে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারব। যদি কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে আমাদের কাছে জানালে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'
দীঘিরজান হাটের ইজারাদার লোকমান হাকিম হিরু বলেন, 'দীঘিরজান গরুর হাট শতবর্ষ পুরনো একটি হাট। এখানে প্রতি শনি এবং মঙ্গলবার হাট বসে। আমার জানামতে পিরোজপুর জেলার সবচেয়ে বড় গরুর হাট এটি। এখানে এ বছর প্রচুর পরিমাণ গরুর আমদানি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব এবং অতিরিক্ত গরমের কারণে ক্রেতা সমাগম কিছুটা কম। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর কোরবানির পশুর দাম কম। পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা টহল রয়েছে। আশা করি আস্তে আস্তে ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়বে।'
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী নন্দীগ্রাম উপজেলার একটি হাট আর সেটি হচ্ছে রণবাঘা হাট। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে জমে উঠেছে রণবাঘার কোরবানির এই গরুর হাটটি। সপ্তাহে শুক্রবার এখানে বিশাল এলাকা নিয়ে গরুর হাট বসে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর ব্যাপক সমাগম ঘটছে এ হাটে। নন্দীগ্রাম উপজেলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে গরু-ছাগল ক্রয়-বিক্রয় করতে আসে এ হাটে ক্রেতা-বিক্রেতারা।
এদিকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের জানমালের নিরাপত্তা ও মহাসড়কে যানজট এরাতে রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের একদল টিম। এ ছাড়া রয়েছে গরু হাটটিতে পুলিশ প্রশাসনের কঠোর নজরদারি।
এবার কোরবানির হাটে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা থাকলেও খুব একটা চাহিদা লক্ষ্য করা যায়নি বড় গরুর। গরু ও ছাগলের দাম রয়েছে বেশ। ক্রেতাদের সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে ধর্মীয় কাজটি সমাধা করতে পশু কিনছেন মানুষ। শুক্রবার উপজেলার ওমরপুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে- ছাগলের পাশাপাশি ভেড়াও যোগ হয়েছে। হাটে গরু বেচাকেনাও জমে উঠেছে। এর মধ্যে দেশি গরুর সংখ্যাই বেশি। গরু বেপারীরা জানান, জেলার অন্য পশুর হাটগুলোতে এবার বিভিন্ন এলাকা থেকে পশু আসছে। তবে বাইরের দেশ থেকে গরু না আসায় বেশি দামে দেশি গরু কিনতে আগ্রহী নন অনেকেই। হাটে ছাগলের আমদানিও যথেষ্ট। ঈদের বাকি আর মাত্র দুইদিন। তাই ঈদকে সামনে রেখে এ হাটে গত কয়েক হাটের তুলনায় দাম ও বিক্রি বেড়েছে। হাটে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দাম চাইছেন বিক্রেতারা। তবে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকার গরু ও ৩৫ হাজার টাকার ছাগল বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ৯০ থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরু বেশি বিক্রি হয়েছে। খাসি ছাগলও বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে।
উপজেলার ১নং বুড়ইল ইউনিয়নের গরু ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, 'গরুর আমদানি বেশি, দামও বেশ ভালো। চাহিদামতো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি। এ বিষয়ে ওমরপুর হাট ইজারাদার জানান, এ হাটে গরুর আমদানি বিগত বছরগুলোর চেয়ে এ বছর ব্যাপক হচ্ছে। তবে দেশীয় গরুর দামও বেশি। দাম ও চাহিদার সমন্বয়ে কেনাবেচা বেশ জমে উঠেছে।'
সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, ঈদকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জমে উঠেছে স্থায়ী ১টি ও অস্থায়ী ১৮টি পশুর হাট। শেষ মুহূর্তে পশুর হাটগুলোতে বাড়ছে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। তবে এ বছর কোরবানির পশুর দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্যমতে, উপজেলায় এ বছর ৪৫ হাজার ২৮০টি কোরবানির পশুর চাহিদার বিপরীতে গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে ৪৩ হাজার ২৮৮টি। যা দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও ১ হাজার ৯৯২টি কোরবানিযোগ্য পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।
সরেজমিন দেখা যায়, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে উপজেলার কেরানিহাট, বাজালিয়া, ফকির হাট ও পুরানগড় পশুর হাটে বিক্রয়ের উদ্দেশে গরু নিয়ে এসেছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারাও শেষ মুহূর্তে এসে হাটগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন। রাস্তার দুই পাশে পশুর হাট বসানোর ফলে কেরানীহাট-বান্দরবান মহাসড়কের বাজালিয়া অংশে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজটের।
উপজেলায় এ বছর সরাসরি খামার ও কোরবানির পশুর হাটগুলোতে অধিক বাণিজ্য হবে। তবে গো-খাদ্য, ওষুধ ও পরিচর্যা খরচের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় হতাশ খামারিরা। অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতাদের দাবি অন্যবারের তুলনায় এবার কোরবানির পশুর দাম বেশি হাঁকানো হচ্ছে।
খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাটগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেলেও বিক্রি তুলনামূলক কম। দাম বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্তরা এবার ঝুঁকছেন ছোট ও মাঝারি সাইজের পশু ক্রয়ের দিকে। ফলে এবারের কোরবানিতে বড় সাইজের গরুর চাহিদা কম বললেই চলে। তবে মাঝারি সাইজের গরু ও ছাগলের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় পশু পালনে খরচ অনেক বেড়েছে। তাই কোরবানির পশুর দাম একটু বেশি বলে জানান বিক্রেতারা।
খামারি আবুল হোসেন বলেন, শুরুতে গরুর দাম ভালো পাওয়া গেলেও শেষ মুহূর্তে এসে অনেকটাই কমে গেছে। শুরুতে বিক্রি করা কয়েকটি গরুতে কাঙ্ক্ষিত দাম পেয়েছি। এখন বাকি গরুর দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। ক্রেতারা আসছেন, গরু দেখছেন তবে দাম শোনার পর চলে যাচ্ছেন।
বিক্রেতা আলী আহম্মদ বলেন, 'ক্রেতারা বাড়িতে গিয়ে আমার গরুর যে দাম চেয়েছিল হাটে আনার পর একই গরুর দাম ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা কমে গেছে। এই দামে গরু বিক্রি করলে খরচ তোলা সম্ভব নয়। কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে গরুটি বিক্রি করব কিভাবে।'
অন্যদিকে ক্রেতারা বলেন, পশুর যে দাম সে তুলনায় মাংস পাওয়া যাচ্ছে না। মাংসের সঙ্গে গরুর দামের হিসাব করলে অনেক ব্যবধান। মাংসের তুলনায় দাম অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফলে পছন্দ অনুযায়ী পশু কেনা যাচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পছন্দের গরুটি কেনার।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, 'এ বছর খামারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে পশু প্রস্তুত করেছেন। তাতে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় দুই হাজার কোরবানিযোগ্য পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। উদ্বৃত্ত পশুগুলো চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলায় সরবরাহ করা হবে। এ বছর গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক কিছুটা বেড়েছে। একটু বাড়তি দাম হলেও নিজ এলাকার হাটগুলো থেকে পশু কেনার আহ্বান জানাচ্ছি। তাতে খামারিরা লাভবান হবেন এবং আগামীতে পশু পালনে আগ্রহী হবে।
সাতকানিয়া থানার ওসি প্রিটন সরকার বলেন, কোরবানির পশুর হাটের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। টহলরত পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পশুর হাটে জাল নোট ও অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের ঠেকানোর জন্য পুলিশের কড়া নজরদারি রয়েছে।