নওগাঁর পোরশায় মাটি খুঁড়লেই মিলছে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। আর এসব প্রত্নতাত্ত্ব্বিক সম্পদ মূল্যবান হওয়ায় প্রায় একযুগের অধিক সময় ধরে এলাকার লোকজন মাটি খুঁড়ে এসব প্রত্নতাত্ত্ব্বিক সম্পদ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি জানাজানি হলেও এগুলো রক্ষায় এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, পোরশা উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রঘুনাথপুর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক ওই সম্পদগুলো উদ্ধারের জন্য প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ি করছে লোকজন। টেকঠা নামক ওই মাঠে প্রায় ১৪ বছর আগে স্থানীয়রা মাটি খনন করে গর্ত থেকে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র পায়। এই জিনিসগুলো ছিল পাথরের তৈরি বিভিন্ন মার্বেল ও তসবিহ জাতীয়। যেগুলো দেখতে সুন্দর এবং মূল্যবানও ছিল। এরপর থেকে ওই মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়ার আসায় মাটি খনন করতে শুরু করে লোকজন। এতে যেখানেই মাটি খনন করে সেখানেই বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পায় তারা। ফলে এসব মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়ার আশায় প্রতিযোগিতা করে এলাকার মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আশপাশের আবাদি জমি ও আমবাগান খনন করেই চলেছেন। পাচ্ছেন দামি সব জিনিসপত্র।
পুনর্ভবা নদীর পূর্বপাড়ের প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে মূল্যবান ওই জিনিসপত্র পাওয়ার প্রতিযোগিতা। কেউ নিজ মালিকানাধীন জমিতে, আবার কেউ অন্যের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে খনন করে এসব জিনিসপত্র উদ্ধার করছেন।
পশ্চিম রঘুনাথপুর জেলেপাড়ার বৃদ্ধ আব্দুল কাদের জানান, ১২-১৪ বছর পূর্বে এখানে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। ফাঁকা মাঠ ছিল। বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্ব্বিক তৈজসপত্র উদ্ধারকে কেন্দ্র করে বসতবাড়ি হয়েছে। তিনি জানান, সর্বপ্রথম তিনি ওই স্থানে কয়েকটি ছোট-ছোট পাথর পেয়েছিলেন। পাথরগুলো যে মূল্যবান তা ধারণা করেননি। পরে তিনি পাথরগুলো দিয়ে তসবিহ তৈরি করে ব্যবহার করেন এবং পরবর্তীতে অন্যজনের কাছে পাঁচশ' টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। বিষয়টি জানাজানি হলে লোকজন শুরু করেন মাটি খনন।
কাদের জানান, এখন প্রতিদিন স্থানীয়রা ৪ থেকে ৫ ফুট মাটি খনন করলেই পাচ্ছেন বিভিন্ন রঙের তামার পয়সা, তাবিজ, তসবিহ পাথর, বিভিন্ন রঙের কলম, পাথরের মার্বেল বিভিন্ন বোতামসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। আর মূল্যবান জিনিস পাওয়া মাত্র তারা বিভিন্ন দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কোনো কোনো পাথরের জিনিস ১০-১২ হাজার টাকা আবার কিছু জিনিসপত্র সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি হয়েছে।
টেকঠা গ্রামের রবিউল জানান, তাদের গ্রামের পাশে পোরশা গ্রামের মৃত ওহাব শাহ্ চৌধুরীর ৩ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি ওই জমি তিন বছরের জন্য ২ লাখ টাকার বিনিময়ে লিজ নিয়েছেন শুধু মাটি খনন করে মূল্যবান সব জিনিসপত্র উদ্ধারের আশায়। এর আগেও তিনি পোরশা গ্রামের অন্যজনের জমি লিজ নিয়ে অনেক মূল্যবান জিনিস পেয়েছিলেন। এতে তার লাভ হয়েছিল।
টেকঠার ফইমুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম জানান, তার বাড়ির পাশে নিজের ৮ শতাংশ জমি খনন করে ১টি চাকতি পেয়ে ৫ হাজার টাকায়, ২টি ঢোল ৫০ হাজার টাকায়, ২টি জালি পোটল ১ লাখ টাকায় এবং কয়েকটি মার্বেল ও বোতাম পেয়ে সেগুলো ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, এই এলাকা একসময় নদী বন্দর হিসেবে ব্যবহার হতো। সে সময় এ এলাকায় হিন্দুদের বসবাস ছিল। কালের বিবর্তনে পরিবারগুলো বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের রেখে যাওয়া মূল্যবান জিনিসপত্র মাটির নিচে চাপা পড়ে। সেই মূল্যবান জিনিসগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা।
তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, টেকঠা নামক স্থানের ক্ষতিসাধন রোধ করে অবৈধ প্রত্নসম্পদ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে ২০২২ সালের শেষের দিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক স্থানীয় প্রশাসন বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু পত্রের আলোকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে নওগাঁর পাহাড়পুর জাদুঘরের কাস্টডিয়ান ফজলুল করিম জানান, ইতোমধ্যে তিনি অধিদপ্তর থেকে চিঠি পেয়েছেন। চিঠির আলোকে তিনি সে স্থানটি পরিদর্শন করেছেন। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আবার তারা স্থানটি পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং সে স্থানটি সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব পাঠাবেন।