মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চাপে কোণঠাসা প্রকৃত খামারিরা
বেচাকেনা কম
প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
বারো মাস ধরে গরু লালনপালন করতে গিয়ে একেকটা গরুর পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। উচ্চ মূল্য গো-খাদ্য, ওষুধ, ডাক্তারি ফি সব মিলিয়ে কোরবানের জন্য একেকটা গরু তৈরি করতে একজন প্রান্তিক খামারির অনেক কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় গরু লালনপালনে ক্ষুদ্র ঋণ, ধার দেনার ধারস্থ হন তারা। ভালো দামে বিক্রি করে ঋণ, ধারদেনা পরিশোধ এবং পরবর্তীতে কয়েকটি গরু কিনে আবারও একই কাজ করে যাবেন এই প্রত্যাশায় খামারিরা অপেক্ষায় থাকেন।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাদের সে প্রত্যাশায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। প্রবাস কিংবা অন্যান্য ব্যবসায় জড়িত থাকলেও কোরবানি এলেই তারা কোটি কোটি টাকা পুঁজি দিয়ে গরুর ব্যবসায় নেমে পড়েন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবসায় তারা বাজিমাত করেন। ফলে সারা বছর ধরে পরিশ্রম করে প্রান্তিক খামারিদের পুঁজি তুলতেই হিমশিম খেতে হয়।
অন্যদিকে সরকারিভাবে বাহির দেশ থেকে আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও চোরাপথে মায়ানমার ও ভারত থেকে গরু প্রবেশ করায় আরও দিশেহারা প্রান্তিক চাষিরা। যার প্রভাব এবার হাটহাজারীতেও পড়েছে। গেল কোরবানিতে অনেক প্রান্তিক খামারি গো-খাদ্যর উচ্চ মূল্য, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চাপ, গরুর ক্ষুরা রোগ, নাপি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত, শেষের দিকে দামে ধস, হিট ওয়েবে মৃতু্যর কারণে অনেকে এবার গরুর ব্যবসা করছেন না। অনেকের খামার গোয়ালঘর খালি পড়ে আছে। তাদের মতে সারাবছর গরু লালন পালনে যে ব্যয়, তা তুলতেই হিমশিম খেতে হয়।
আর দুদিনের ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা গরু এনে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে ভালোই ব্যবসা করে। তাদের তুলনায় আমরা অতি নগণ্য। কৃত্রিমভাবে নামেমাত্র খরচে দেহের জন্য ক্ষতিকর বিশাল আকারের গরু দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তাই অনেকেই এ পেশা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যবসার উদ্দেশে কোরবানির নিকটতম সময়ে দেশের কুষ্টিয়া, বগুড়া, নেত্রকোনা ও পাহাড় থেকে এনে বিক্রিতে নেমেছেন তবে তার সংখ্যা খুবই কম।
খামারি জাহেদুল ইসলাম, মোরশেদ বলেন, গতবারের চেয়ে এবার গরুর সংখ্যা কম। গো-খাদ্যের উচ্চ মূল্য এর প্রধান কারণ। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণ তো আছেই। খামারি মনছুর শাহ বলেন, গতবার ৩৯টি গরু ছিল। সারাবছরের ব্যয়ে পুঁজি তুলতেই ঘাম বেরিয়ে যায়। তাই এবার খামার শূন্য।
সরেজমিন বিভিন্ন বাজার, খামারের বিক্রেতা ও ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিক্রি এখনো কম। একদিকে চড়া দাম, অন্যদিকে রাখার জায়গা না থাকা। তবে বড় বড় বাজার থেকে পাইকারি দরে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিদিন গরু কিনে তাদের সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। যে গরু (ছোট) গতবার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা তা এবার ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুজন কানুনগো যায়যায়দিনকে বলেন, গো-খাদ্যের উচ্চ মূল্যে একজন প্রান্তিক খামারির বেঁচে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত গতবারের গরুর ক্ষুরা রোগ, নাপি স্কিন ডিজিজ রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং কোরবানির শেষ মুহূর্তে দাম পড়ে যাওয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ধরনে প্রান্তিক খামারির সংখ্যা কমে গেছে।
গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার ৭৮২ খামারের তালিকা থাকলেও তা নেমেছে ৭শ'র নিচে। যার কারণে এ বছর চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশুর সংখ্যা কম। ৫১ হাজার ২৬৫ গবাদিপশুর চাহিদা থাকলেও প্রাপ্যতা ৪৪ হাজার ৯৮১। ৬ হাজার ২৮৪ ঘাটতি রয়েছে। যদিও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চাহিদার কয়েকগুণ বেশি পশু ইতোমধ্যে নিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, তাদের পাঁচটি মনিটরিং টিম কাজ করছে বিভিন্ন হাটে। তবে এবারের ইতিবাচক দিক হচ্ছে গরুর রোগবালাই কম।
গতবার রোগবালাইয়ে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবার প্রায় গরুই ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। এদিকে হাটহাজারী উপজেলা ও পৌরসভায় মাত্র পনেরটি বাজার ইজারার আওতায় থাকলেও প্রায় প্রত্যেক পাড়া মহলস্নায় বিভিন্ন এগ্রো'র নাম দিয়ে গরুর ব্যবসায় নেমেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইজারাদার বলেন, লাখ লাখ টাকা ইজারা দিয়ে বাজার নিয়েছেন। কিন্তু পথে প্রান্তরে বাজার বসছে দেদার। তাদের কারণে ক্রেতা বাজারবিমুখ। কীভাবে ইজারার টাকা তুলব। বিষয়টি প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, মানুষের দুর্ভোগ তৈরি করে বিশেষ করে সড়কের উপর বাজার বসতে দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিকারপুর ও বুড়িশ্চরে অবৈধভাবে গড়ে উঠা দুইটি বাজার ভেঙে দিয়েছেন। চেষ্টা করা হচ্ছে সবাইকে একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে নিয়ে আসার। কেউ ইজারা না নিয়ে বাজার বসানোর চেষ্টা করলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।