শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

নেছারাবাদের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

শিশির কর্মকার, নেছারাবাদ (পিরোজপুর)
  ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
নেছারাবাদের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

পিরোজপুর নেছারাবাদের অজপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রাম বিন্না। গ্রামটিকে এখন সবাই চেনে 'ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম' হিসেবে। উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত এই জনপদটিতে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া পড়েনি এখনো। তবুও বসে নেই এই গ্রামের নারী-পুরুষ।

উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন না লাগলেও এই গ্রামকে অনেকেই চেনেন 'ব্যাট কালামের গ্রাম' হিসেবে। ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে হাজারও কারিগরের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এই নেছারাবাদ উপজেলায়। নেছারাবাদে তৈরি ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

কয়েকযুগ থেকেই কাঠ ব্যবসাসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিত নেছারাবাদের ইন্দেরহাটসহ বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া ও বলদিয়াসহ অন্তত আরও ১৫টি গ্রাম। আর এসব গ্রামেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। বর্তমানে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিকেরও বেশি। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০-১২ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে শত শত ব্যাট তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। দেশের শতভাগ চাহিদা পূরণের পর উন্নত মানের ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে বিদেশেও।

জানা গেছে, যে হাজার হাজার দেশীয় ব্যাটের ব্যবহার হয়, এর মূল কারিগর নেছারাবাদের বেলুয়া নদীর তীরে উড়িবুনিয়ার ছুতার পরিবারে জন্ম নেওয়া অতি দরিদ্র মৃত আব্দুল লতিফ মিয়া। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে জুরাইনের খেলার সাথী নামে একটি কাঠের কারখানায় কাজ পান। সেখান থেকেই বিভিন্ন খেলার সামগ্রী মেরামতের কাজ করতেন। এরপর থেকেই লতিফের মাথায় চেপে বসে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির নেশা। বিদেশি ব্যাট তৈরির সমমানের স্থানীয় গাছের সন্ধান করতে থাকেন। খুঁজে বের করেন দেবদারু, কদম ও বাইনসহ নানা প্রজাতির গাছ। কাঠ দিয়ে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। সস্তায় ব্যাট তৈরির টার্গেট নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে।

নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন ব্যাট তৈরির কারখানা। ঢাকার বাইরে নেছারাবাদে এটাই ব্যাট তৈরির আদি কারখানা। লতিফ মিয়া কারখানাকে ভিত্তি করে ঢাকায় আমদানিকৃত ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি দোকানে স্থান পায় নেছারাবাদের ক্রিকেট ব্যাট। এভাবেই রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে ব্যাটের কারখানা। লতিফের সহকর্মী কালাম নিজ বাড়িতে যে বিরাট কারখানা তৈরি করেছেন, এর সৌরভ ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে।

ব্যাট তৈরির কারিগর আবুল কালামের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছিলেন স্বামীর ক্রিকেট কারখানার অন্যতম মালিক হিসেবে। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে নিলুফা যোগ দেন। পদক্ষেপ নামের একটি এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রম্নপের সফল শিল্প উদ্যোক্তা নিলুফা। ওই বছরই নিলুফা ঢাকায় সিটি গ্রম্নপ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার পান।

কানাডার সম্মেলন থেকে অন্যান্য পুরস্কার ছাড়াও নিলুফাকে চার হাজার মার্কিন ডলার নগদ অর্থ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। বাংলাদেশি দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা সমমানের এই উপহারের অর্থ দিয়ে কালাম-নিলুফা দম্পতি জমি কিনে বাড়ি ও ব্যাট কারখানা গড়ে তুলেছেন।

জানতে চাইলে নেছারাবাদ বিসিক ম্যানেজার বলেন, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা বিসিক শিল্পনগরী ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। এখানকার ব্যাট দেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও যাচ্ছে। নেছারাবাদের ব্যাট শিল্প এবং অত্র শিল্পের কারিগরদের স্বীয় পেশায় টিকিয়ে রাখতে হলে এই খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কাঁচামালের মূল্য কমানোসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে পেশার মান উন্নত ও ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখতে পাবে।

নেছারাবাদ ইউএনও মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এই উপজেলায় একাধিক গ্রামে ব্যাট ও স্ট্যাম্পের কারখানা গড়ে উঠেছে। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন সবসময় নজর রাখছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে