হুমকির মুখে পরিবেশ

মেহেরপুরে সড়ক উন্নয়নের অজুহাতে ফের দেড় হাজার গাছ কাটার পাঁয়তারা

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০

গোলাম মোস্তফা, মেহেরপুর
গত বছর মেহেরপুরে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কে অন্তত দুই হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের বট, পাকুড়, মেহগনি, শিশু, কড়াই, রেইনট্রি, কাঁঠাল, আম, জামসহ নানা প্রজাতির গাছ ছিল ওইসব সড়কের পাশে। গাছগুলো কাটার ফলে রাস্তার দুই পাশ ফাঁকা হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে মরুভূমির পরিবেশ। এই পরিস্থিতির রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও সড়ক উন্নয়নের অজুহাতে মেহেরপুর-মুজিবনগর ও মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে আরও ১ হাজার ৪৪০টি গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে মেহেরপুর সড়ক বিভাগ। এরইমধ্যে মেহেরপুর জেলা পরিষদ বরাবর একটি চিঠি দিয়ে গাছগুলো কাটার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের আমঝুপি পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা তৈরির কাজ হবে। যাতে প্রধান বাধা হয়ে আছে রাস্তার পাশে ৯৭৬টি ছোট বড় বিভিন্ন বনজ ও ফলজ গাছ এবং মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কে ৪৬৪টিসহ মোট ১৪৪০টি গাছ কাটা হবে। এমন খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবিদরা। সরেজমিনে সড়ক দু'টিতে গিয়ে দেখা গেছে বট, পাকুড়, মেহগনি, শিশু, কড়াই, রেইনট্রি, কাঁঠাল, আম, জামসহ নানা প্রজাতির গাছে লাল রং করে নাম্বারিং করা হয়েছে। লাল রং অর্থ হচ্ছে গাছের মৃতু্য পরোয়ানা। দেখা গেছে কিছু গাছ রয়েছে সড়কের একটু ওপরে, আবার বেশির ভাগ গাছ রয়েছে সড়কের বাইরে। তবে প্রায় সবগুলো গাছেই নাম্বারিং করা হয়েছে। এসব গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মেহেরপুরের সাধারণ মানুষ। তাদের মতে যদি শতবর্ষী পুরনো গাছ কেটে ফেলা হয় তাহলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। গত বছর যে সব গাছ কাটা হয়েছে ওইসব এলাকা এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তার ওপরে এ বছর তীব্র তাপদাহে মানুষ ও প্রাণিকুলের জীবন ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম। বড় গাছপালা কেটে উজার করার কারণে তাপদাহ আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে পারবেশবিদদের দাবি। গাছ, পাহাড়, নদী ও জীববৈচিত্র্য পরিবেশের প্রাণ। সেই গাছ নিধন করায় বিপাকে পড়েছে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রাণিকুলও। গাছগুলোর নিচে পথচারী ও শ্রমিকরা কাজের মধ্যে বিশ্রাম নেন। পশুপাখিদের আবাসস্থল। পাখিকুলের খাদ্যের উৎস এইসব গাছ। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে শতবর্ষী গাছগুলো। গাছ কাটার কারণে খাদ্য সংকটে পড়ছে পাখি। গাছ কাটার কারণে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষ। মুজিবনগর উপজেলার সদ্যনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান রাজিব হোসেন বলেন, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের গাছগুলো কেটে ফেলায় এখন দিনে চলাচল করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। অথচ বছরখানেক আগেও এই সড়কটি ছিল সবুজে ঘেরা। আবার মুজিবনগর ও চুয়াডাঙ্গা সড়কের প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি সত্যই কাটা হয়, তবে তা হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতি। ছহিউদ্দীন ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রেজা বলেন, 'আমরা যে কোনো ধরনের গাছ কাটার বিরুদ্ধে। প্রকৃতির প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রাণ। সেই প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম উপাদন হচ্ছে অক্সিজেন। এই অক্সিজেন আমরা বায়ুমন্ডল থেকে পাই। তবে প্রকৃতির গাছপালা ছাকনি হিসেবে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বিধায় বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। অথচ সেই গাছপালা আমরা অবাধে কেটে ফেলছি। এতে আমরা নিজেরাই আমাদের বাঁচার প্রধান অনুষঙ্গ নির্মল অক্সিজেন গ্রহণের পথ বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাদের দাবি নিয়ম অনুযায়ী গাছ যদি কাটতেই হয় তাহলে কর্তনকৃত গাছের দ্বিগুণ গাছ লাগাতে হবে।' মেহেরপুর বার্ড ওয়াচিং ক্লাবের সভাপতি এমএ মুহিত বলেন, 'গাছ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী, পাখিদের আবাসস্থল। কোনো পাখিই আমাদের কাছে খাবার চায় না। বনের, রাস্তার ধারের ওই গাছগুলো থেকেই তারা খাবার সংগ্রহ করে। অথচ সেই গাছগুলো সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে। আমাদের গাছও দরকার, সড়কও দরকার।' তিনি এই বর্ষা মৌসুমেই নতুন সড়কের দু'পাশে বনবিভাগের মাধ্যমে আবারও গাছ রোপণ করার দাবি জানান। মেহেরপুর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এস.টি হামিম হায়দার বলেন, সড়কের দু'পাশে আবারও গাছ রোপণ করার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাবনা পাঠানো হবে। নির্দেশনা পেলে এসব রাস্তায় নতুন করে গাছ লাগানো হবে। গাছগুলো কেন কাটা হচ্ছে জানতে চাইলে মেহেরপুর সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, 'গাছগুলো রাস্তার ওপরে চলে এসেছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাছাড়া গাছগুলোর কারণে সড়ক সংস্কার বা প্রশস্ত করা যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা জেলা পরিষদকে চিঠির মাধ্যমে তালিকাসহ গাছগুলো কাটার ব্যবস্থা করতে বলেছি।' মেহেরপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, আমরা একটি তালিকাসহ চিঠি পেয়েছি। আমাদের সার্ভেয়ার (পর্যবেক্ষক) যাবে। তারা যেগুলো কাটা প্রয়োজন বলে মনে করবে সেগুলোই কাটা হবে। মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক শামীম হাসান বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় গাছ যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও এলাকার উন্নয়নে উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থাও খুব জরুরি। সড়ক নির্মাণ করার পরেও সড়ক ও জনপথের আরও যায়গা থাকছে। সেখানে পুনরায় নতুন করে কীভাবে গাছ রোপণ করা যায় সে বিষয়ে বনবিভাগকে উদ্যোগী হতে বলা হয়েছে। মেহেরপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর-মুজিবনগর ভায়া দর্শনা সড়কে মানুষের চলাচলে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন মানুষ বাড়ার সঙ্গে সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত করছে। ওইসব সড়ক সম্প্রসারণ করায় কিছু গাছ কাটা পড়ছে। সড়কের কাজ শেষ হলেই পুনরায় যাতে গাছ রোপণ করা হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।