সুবিধা নিচ্ছেন কার্ডধারী ব্যবসায়ীরা

সরকারি গুদামে ধান-চাল বিক্রিতে অনলাইনের ফাঁদে প্রান্তিক কৃষক

প্রকাশ | ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
কুড়িগ্রামের চিলমারীতে সরকারি খাদ্যগুদামে ভুয়া কৃষকের তালিকায় ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রের কাছ থেকে। ধান বেচাকেনার প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করা হলেও কিভাবে ভুয়া কৃষকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় কৃষকরা। এদিকে ভুয়া তালিকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ৬ ইউনিয়নে মোট ২২৯ জন কৃষকের কাছ থেকে ৬৮৮ মেট্রিকটন ধান, ৪৫ টাকা প্রতি কেজি দরে উপজেলার ৪০ জন মিলারের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৬ মে.টন চাল ও প্রতি কেজি ৩৪ টাকা দরে ৯০ মে.টন গম কেনা হবে। চিলমারী এলএসডি ভবনের তালিকায় টাঙানো উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট ২২৯ জন কৃষকের মধ্যে এ পর্যন্ত ২০ জন কৃষক ৬০ মেট্রিকটন ধান গুদামজাত করেছেন। তবে ওই ২০ জন কৃষকের তালিকা দেখাতেও অপারগতা প্রকাশ করেন দায়িত্বরত মাইদুল ইসলাম নামে এক কর্মচারী। তিনি বলেন, তালিকা নিতে হলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের প্রত্যয়ন দেখাতে হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলা খাদ্যগুদাম চত্বরে ধান বোঝাই ট্রলি অপেক্ষা করছে। এ সময় কৃষকদের উপস্থিতি না থাকলেও কয়েকজন ধান ব্যবসায়ীকে দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেট চক্র নানা কারসাজির মাধ্যমে কৃষকের ভুয়া তালিকা দেখিয়ে গুদামে ধান দিচ্ছে। পরে তালিকার সূত্র ধরে উপজেলার থানাহাট, রমনা, রাণীগঞ্জ, নয়ারহাট, অষ্টমীর ও চিলমারী ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত কৃষকদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা চিলমারীর বাসিন্দা নন বলে জানান। তালিকাভুক্ত থানাহাট ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলাম যার ভোটার আইডি ৮৬৭০০৮৫১৩৬, মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি খুলনার বাসিন্দা বলে জানান। জিলস্নুর রহমান ভোটার আইডি ৭৩২০৩০৫৬০৫, আরেকজন তালিকাভুক্ত কৃষকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি চিলমারী থানার এসআই দিলীপ কুমার রায় বলে পরিচয় দেন। অষ্টমীর চর ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত কৃষক আব্দুল মালেক যার ভোটার আইডি নং ১৯২০২০০৯২০০, তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রং নাম্বার বলে কেটে দেন। নয়ারহাট ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত কৃষক সাদেক হোসেন যার ভোটার আইডি ৪৬২১৪১৮২৩৭, যোগাগোগ করা হলে তিনি লালমনিরহাট বড়বাড়ী এলাকার বলরাম বলে পরিচয় দেন। একইভাবে অন্য ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে একই অবস্থা দেখা গেছে। থানাহাট ইউনিয়নের পূর্বমাচাবান্দা এলাকার আমিনুল ইসলাম বীর বলেন, প্রতি বছরই সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের সময় অভিযোগ ওঠে। ধান ক্রয়ের সময় কৃষকরা ধান গুদামে দিতে না পারলেও ভুয়া তালিকায় একটি সিন্ডিকেট চক্র ধান দেয়। অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া হলে কিভাবে ভুয়া কৃষক অন্তর্ভুক্ত হয় তা খতিয়ে দেখা জরুরি। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কুমার প্রণয় বিষাণ দাস বলেন, 'কৃষকরা অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন করেছিল। আমরা ইউএনওকে আবেদনকৃত তালিকা সরবরাহ করেছি। তিনি লটারি করেছেন। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।' চিলমারী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা আলাউদ্দিন বসুনিয়া বলেন, এ পর্যন্ত ৬০ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। ধান সংগ্রহের সময় কৃষকের কৃষি কার্ড ও ভোটার আইডি মিলিয়ে ধান নেওয়া হয়েছে। ইউএনও মিনহাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা সাইফুল কবির খান বলেন, 'কৃষি অফিসের বস্নক সুপার ভাইজার মাঠ পরিদর্শন করে যে তালিকা প্রণয়ন করে সে তালিকা ধরে আমরা ধান ক্রয় করি। এখানে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।' এদিকে রাউজান (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, দেশের প্রান্তিক কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সরকার এই বোরো মৌসুমে ৩২ টাকা কেজি দরে ধান কেনার ঘোষণা দিয়ে কৃষিজীবীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর সমন্বয়ের অভাবে হাজারো প্রান্তিক কৃষক এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সচেতন মহল মনে করছেন ধান ক্রয়ের নীতিমালার ফাঁদে আটকে অনেক কৃষক সরকারি গুদামে ধান নিয়ে বিক্রি করতে পাচ্ছেন না। ধান বিক্রি করতে না পেরে কৃষকরা কম দামে ফরিয়াদের হাতে ধান তুলে দিচ্ছেন। প্রান্তিক কৃষক ও সচেতন মহল থেকে উঠা এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে রাউজানে সরকারি গুদামে ধান ক্রয়-বিক্রয়কালে। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- যেসব কৃষক সরকারের কাছে সরাসরি ধান বিক্রি করতে আগ্রহী তাদের আগে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। কৃষকদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সেগুলো লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকরাই শুধু সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান খাদ্য গুদামে বিক্রয় করতে পারে। সূত্র মতে এবার রাউজান থেকে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আছে ৪৪১ মেট্রিকটন। এখানে ধান সংগ্রহ কর্যক্রম শুরু হয় গত ৩০ মে। প্রথমদিন দেখা যায় গুদামের বাইরে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। প্রান্তিক কৃষকরা ধানের বস্তা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করলেও গুদামে ধান বিক্রিতে তৎপরতা ছিল তথাকথিত কৃষক কার্ডধারী ফড়িয়াদের, যাদের রয়েছে হাট বাজারে, রাইসমিলে ধান চালের ব্যবসা। এখানে ধান নিয়ে আসা কৃষকদের মধ্যে একজন নুর মিয়াসহ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এখানে ধান নিয়ে এসেছিলেন ৩২ টাকা কেজি দরে সরকারি গুদামে ধান দিতে। তালিকায় নাম নেই এই অজুহাতে ধান নিচ্ছে না গুদামে। আবার কেউ কেউ বলেছেন তারা সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে না পেরে সরকার নির্ধারিত দরের চাইতে কেজিতে দুই টাকা কমে এখানে তৎপর কথিত কৃষক ফড়িয়াদের হাতে তুলে দিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। জানা যায়, কয়েকজন কৃষক এমন ভোগান্তির কথা মোবাইলে জানিয়েছেন রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবদুল ওহাবকে। তিনি তাৎক্ষণিক বিষয়টি জানিয়েছেন ধান সংগ্রহকারী সরকারি কর্মকর্তাদের। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করতে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বললে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ফড়িয়াদের প্রভাব বলয়ের কাছে সরকারি কর্মকর্তারাও নতস্বীকার করেছেন। সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে অনলাইনে আবেদন করতে হবে এমন তথ্য প্রান্তিক কৃষকদের আগে জানানো হয়নি। চালানো হয়নি প্রচারণা। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে অনলাইনের ফাঁদে আটকিয়ে সংশ্লিষ্টরা ফড়িয়াদের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা আগেই চূড়ান্ত করে রেখেছে। তার দাবি- গ্রামে যারা কৃষিকাজ করে তারা অনলাইন কি বোঝে না। আগে এই বিষয়ে প্রচারণা চালানো হলে আজ শত শত কৃষক সরকারের দেওয়া সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো না। এবিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, 'সরকারের নির্দেশনায় রাউজানের প্রান্তিক কৃষক পর্যায় থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে ৪৪১ টন ধান সংগ্রহ কর্মসূচি চলমান আছে। অনলাইনের আবেদন করা কৃষকদের মধ্যে যারা লটারিতে বিজয়ী হয়েছে তারাই ধান দিচ্ছেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মাসুম কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৯১ জন কৃষক অনলাইনে ধান বিক্রির আবেদন করেছেন। এর মধ্যে ৮১ জন লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রকৃত কার্ডধারি কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে। উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা অসিত বরণ তালুকদার বলেন, কৃষক নির্বাচন ও প্রচারণার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। তাদের নির্বাচন করা কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে।