শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
ইন্দুরকানীতে খাবার পানির তীব্র অভাব, পাঁচ দিন ধরে নেই বিদু্যৎ!

রেমাল :মৌলভীবাজার-পটুয়াখালীতে কয়েকশ' কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

স্বদেশ ডেস্ক
  ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে মৌলভীবাজারে সড়ক পস্নাবিত ও পটুয়াখালীর গলাচিপার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় -যাযাদি

ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। শুধু মৌলভীবাজারেই সড়ক বিভাগের ২৬ কোটি ও পটুয়াখালীর গলাচিপায় ১৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে খাবার পানির তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। পাঁচদিন ধরে বিদু্যৎ নেই ওই উপজেলায়। আমাদের আঞ্চলিক স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্র্ট-

স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার জানিয়েছেন, সারাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল'-এর তান্ডবে সড়ক ধস, পাহাড় আছড়ে ও তলিয়ে গিয়ে মৌলভীবাজারে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রায় ২৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার সওজ বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় রেমাল চলে গেলেও তার স্মৃতি এখনো রয়েই গেছে। জেলার পাহাড়ি এলাকা থেকে এখনো পানি নেমে সড়কের বিভিন্ন জায়গা তলিয়ে গেছে। আর এই তলিয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করায় আরও দেবে যাচ্ছে সড়ক।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সড়ক বিভাগের অধীনে থাকা রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ি-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার সড়কের চেইনেজ ৪২ কি.মি. থেকে ৪৬ কি.মি. পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সড়ক, মৌলভীবাজার-শমসেরনগর-চাতলা চেকপোস্ট সড়কের চেইনেজ ৬.৯শ' কি.মি. থেকে ৭ কি.মি. পর্যন্ত একশ' মিটার, বড়লেখা-শাহবাজপুর-লাতু সড়কের চেইনেজ শূন্য কি.মি. থেকে ৭৫০ মিটার পর্যন্ত ৭৫০ মিটার, জুড়ী-ফুলতলা-বটুলী সড়কের চেইনেজ ৫.৫০০ কি.মি. থেকে ৫.৬০০ কি.মি., ১০ কি.মি. থেকে ১০.১০০ কি.মি., ১১.৯০০ কি.মি. থেকে ১২.৬০০ কি.মি., ১৫.৮০০ কি.মি. থেকে ১৬.৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোট ১.৮শ' কিলোমিটার ও কুলাউড়া (গাজীপুর)-জুড়ী (সাগরনাল) উপজেলা সংযোগ সড়কের আরও চেইনেজ ৭.৮০০ কি.মি. থেকে ৮ কি.মি. পর্যন্ত আরও ৫শ' মিটার সড়ক জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে মোট ৭.১৫০ কিলোমিটার জায়গার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সড়ক বিভাগ জানায়, এসব জায়গায় দীর্ঘমেয়াদি মেরামত করতে তাদের ব্যয় হবে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। আর স্বল্পমেয়াদি মেরামত করতে ব্যয় হবে ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

মৌলভীবাজার সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার হামিদ বলেন, 'জেলার ৫টি জায়গায় আমাদের সড়কের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আপাতত জায়গাগুলো মেরামত করতে ব্যয় হতে পারে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় রেমাল চলে গেলেও পাহাড় থেকে এখনো পানি নামছে। এসব পানি নামা বন্ধ হয়ে গেলে জরিপ করে পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আরও পাওয়া যাবে।'

গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে পটুয়াখালীর গলাচিপায় ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার গলাচিপা সদর, ডাকুয়া ও পানপট্টি ইউনিয়ন অত্যন্ত নদীভাঙন প্রবণ এলাকা। এসব ইউনিয়নের যেসব বেড়িবাঁধ রয়েছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণের কথা থাকলেও বেশকিছু জটিলতার কারণে এখনো তা সম্ভব হয়নি।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে যখন পানপট্টি বোর্ড এলাকায় বাঁধটি বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীব্র গতির ঢেউয়ে ভাঙন শুরু হয় তখন ইউএনও মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল সেখানে উপস্থিত হয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে দুইটি ভেকু (মাটি কাটার যন্ত্র স্কভেটর) দ্বারা প্রায় ১৬ ঘণ্টা মাটি কেটে ফেলে এবং কর্মকর্তা, শিক্ষক ও স্থানীয় যুবকদের নিয়ে জিওব্যাগ ফেলে মূল বাঁধের পাশ দিয়ে আরেকটি বাঁধ তৈরি করা হয়। বিষয়টি সিনেমাটিক ও আপাত হাস্যকর মনে হলেও ঘূর্ণিঝড় শেষে দেখা গেছে ঢেউয়ের তোপে মূল বাঁধটি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, আর নতুন বাঁধটি টিকে গেছে। এছাড়া ডাকুয়া ইউনিয়নের তেঁতুলতলায় উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় নতুন করে কয়েক হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয় দুর্যোগের সময়। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় এসব বেড়িবাঁধ বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেষ মুহূর্তের কর্মকান্ডের জন্য বিলীন হয়ে যায়নি।

এসব বেড়িবাঁধ রক্ষা করতে না পারলে গলাচিপা পৌরসভাসহ অন্তত ৬টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণরূপে পানিতে নিমজ্জিত হতো এবং ভেসে যেত হাজার হাজার ঘর-বাড়ি, পশু-পাখি, ফসলের ক্ষেত, মাছ, রাস্তাঘাট। এর ফলে বেঁচে গেল হাজার হাজার মানুষের জীবন। গলাচিপা ইউএনও এ কাজের জন্য সব শ্রেণির মানুষের ভূয়সী প্রশংসায় ভাসছেন।

তাছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে পানপট্টি, বোয়ালিয়া, রতনদি তালতলী, ডাকুয়া, আমখোলা, চিকনিকান্দি, গজালিয়া, গোলখালী, নলুয়াবগী, কলাগাছিয়া, চরকাজল, চরবিশ্বাস এবং গলাচিপা পৌরসভাসহ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া অসহায় মানুষের মধ্যে চিড়া, মোম, মশার কয়েল, পানি, স্যালাইন, জেরিকান, বিস্কুটসহ নানা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে উপজেলা প্রশাসন। এতে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সদস্যরা। গত মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ইউএনও মহিউদ্দিন আল হেলাল জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালে উপজেলার পাকা-কাঁচা সড়ক, মাছের ঘের ভেসে গেছে, ঘরবাড়ি গাছপালা উপড়ে পড়েছে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৫০ কোটি টাকা। এ উপজেলা রাবনাবাদ, আগুনমুখা, তেঁতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ নদী সব দিক দিয়ে ঘেরা। প্রচন্ড ঝড়ে বুড়াগৌরাঙ্গ, তেঁতুলিয়া, রাবনাবাদ এবং আগুনমুখা নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০-১২ ফুট উচ্চতায় বেড়ে গেলে ইউনিয়ন রক্ষাবাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম তলিয়ে যায়। চর কারফার্মায় বেড়িবাঁধ না থাকায় সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। সম্পূর্ণ ঘর ভেঙেছে ৯৪৭টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহস্রাধিক, মাছের ঘের সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫৭ হেক্টর এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৬০ হেক্টও, যার মূল্য প্রায় ২.৫ কোটি টাকা, বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫.৬ কি.মি. এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০-৫০ কি.মি., বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হেক্টর, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১৩১০ হেক্টর এবং নার্সারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হেক্টর, কাঁচা-পাকা সড়ক সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০০ কি.মি., শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক, গৃহপালিত পশু-পাখি ভেসে গেছে প্রায় ৫ হাজারটি। তিনি জানান, এসব ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সরকারি সাহায্যের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) প্রতিনিধি জানান, ইন্দুরকানীতে খাবার পানির তীব্র সংকট ও পাঁচ দিন ধরে বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে পুরো উপজেলা। ঘূর্ণিঝড় রেমালে পানিবন্দি হয়ে আছে ২৫টি গ্রামে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রেমালে বিধ্বস্ত উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিশুদ্ধ পানির অভাবে হাহাকার করছে মানুষ। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এছাড়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পস্নাবিত হয়ে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রান্নাবান্না বন্ধ রয়েছে অনেক পরিবারের। রয়েছে শুকনো খাবারেরও সংকট। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পানিবন্দি অনেকের। অন্যদিকে উপজেলা বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় বন্ধ রয়েছে যোগাযোগ। বিদু্যৎ না থাকায় সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোর কার্যক্রম থমকে আছে। গ্রামীণ সিমের সিগনাল আসে-যায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মোবাইল চার্জের কিছু দালাল আছে জেনারেটর দিয়ে মোবাইল চার্জ করে দিলে নিচ্ছে ৫০ টাকা করে।

পলস্নীবিদু্যৎ অফিসের ইনচার্জ ইসলাম হাওলাদার জানান, 'ঘূর্ণিঝড় রেমালে উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গাছ পরে বিদু্যতের খুঁটি ভেঙে গেছে। এছাড়া এ উপজেলায় গাছ ভেঙে পড়ে বিদু্যতের লাইনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ জনবল নিয়ে চেষ্টা করছি। আশা করছি শিগগিরই বিদু্যৎ সচল হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে