শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

বিধ্বস্ত বাড়িতে ফিরতে পারছেন না আশ্রয় কেন্দ্রের মানুষ

স্বদেশ ডেস্ক
  ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০
বিধ্বস্ত বাড়িতে ফিরতে পারছেন না আশ্রয় কেন্দ্রের মানুষ

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। কয়েক লাখ লোক ঘরহারাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিধ্বস্ত বাড়িতে ফিরতে পারছেন না আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ। রেমালের প্রভাবে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে পস্নাবিত হয়েছে ব্যাপক এলাকা। আমাদের আঞ্চলিক অফিস, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

বরিশাল অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালে বরিশালে প্রায় দুই লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৫৫টি বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বাড়ি। জেলা প্রশাসন এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এরইমধ্যে জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চলমান রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত জেলার ৯৫টি ইউনিয়নে ও সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে ৩ জনের মৃতু্যর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার। দুই হাজার ৪৬৭টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতির পাশাপাশি ২৫৫টি বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেক মাছের ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে, যার ক্ষতি নিরূপণ করতে আরও দুদিন সময় লাগবে।

অন্যদিকে নগরীর অনেক রাস্তা এখনো পানির নিচে রয়েছে। জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে দ্রম্নত ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকেই ত্রাণ সহায়তা পায়। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রথমে ১৫ লাখ টাকা, পরে আরও ১০ লাখ টাকার পাশাপাশি ৩০০ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ বরিশালের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার দুপুর থেকে অভ্যন্তরীণসহ সব রুটে লঞ্চ ও নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে মেহেরপুর জেলায় বেশ কিছু ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে কলা ও পেঁপের ক্ষেত বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এছাড়াও সবজি ক্ষেত ও আম লিচুর ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গায় গাছ-গাছালিও উপড়ে পড়েছে।

গত রোববার সন্ধ্যা থেকে বাতাস আর বৃষ্টি শুরু হয়। এরপর টানা সোমবার দিনগত রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয় ঝড়সহ বৃষ্টিপাত। এতে উঠতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান চাষিরা। তবে মাঠ পর্যায়ে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, ইতোমধ্যে চাষিরা বোরো ধান ঘরে তুলে ফেলেছেন। এখন মাঠে পাট আছে, যা এই বৃষ্টির কারণে চাষির উপকার হয়েছে। তবে কলা বাগানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। সার্বিক দিক দিয়ে এই বৃষ্টিতে চাষিদের উপকার হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের মূল বেড়িবাঁধের প্রায় ৪০ মিটার ধসে পড়েছে। গত সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাঁধটির মোহনপুর এলাকায় এই ধসের দেখা দেয়।

উপজেলার মোহনপুর এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহমুদ বলেন, 'আমরা মঙ্গলবার সকালে বাঁধ ধসে পড়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকজন নিয়ে সেখানে যাই। গিয়ে দেখি, বেড়িবাঁধটির দক্ষিণ-উত্তর পাড়ের প্রায় ১০০ ফুট জায়গা মেঘনার দিকে ধসে পড়েছে। এ সময় বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।'

সেচ প্রকল্পের মূল বেড়িবাঁধ ঘুরে দেখা গেছে, মোহনপুর এলাকায় প্রায় ৪০ মিটার এলাকা ধসে পড়েছে। সেখানে বিরাট গর্ত ও ফাটল দেখা দিয়েছে। বাঁধটির ধসে পড়া স্থান দেখতে সেখানে ভিড় করছেন স্থানীয়রা।

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প পানি ব্যবহারকারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সরকার মো. আলাউদ্দিন বলেন, 'নির্মাণের পর থেকে এ পর্যন্ত দুইবার বাঁধ ভেঙে যায়। লাখ লাখ টাকার ফসল ও ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়। মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ সুরক্ষার জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। তবে রোববারের ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বেড়িবাঁধের প্রায় ৪০ মিটার ধসে পড়ে ক্ষতি হয়েছে। এই স্থান মেরামতের জন্য আপাতত কোনো বরাদ্দ নেই। আমি মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রম্নত মেরামতের চেষ্টা করব।'

মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) ওয়াহিদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, 'খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লোক মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে গিয়েছে। কোন কোন জায়গায় ক্ষতি হয়েছে, কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তারা আসলে আমরা জানতে পারব। পরে আমরা প্রস্তাব আকারে বরাদ্দের জন্য পাঠাব। বরাদ্দ আসলে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো মেরামত করা হবে।'

বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে উপকূলীয় জেলা বরগুনার বেতাগী উপজেলা। এতে ঘুমহীন রাত কেটেছে উপকূলের বাসিন্দাদের। ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের ক্ষেত, উপড়ে গেছে বহু গাছ। ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় যাবৎ বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে পুরো উপজেলা। গত রোববার দুপুর থেকে সোমবার সারাদিন জোয়ারের পানিতে ৩৫ কিলোমটার বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকশ' গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। এছাড়া উপজেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক কাঁচাবাড়ি ঘর বিধ্বস্তসহ উপড়ে পড়া গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিষখালী নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে বলইবুনিয়া, কাউনিয়া, বদনিখালী, কাঠালতলী, চরখালী, কালিকাবাড়ি, আলিয়াবাদসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। ফলে এসব এলাকার মৎস্য খামারের অন্তত ৪০টি মাছের ঘের, ২৫০টি পুকুর পানির নিচে তলিয়ে আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকাল থেকে ঝড়োহাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হলে নদীতীরের মানুষ আতংকে পার্শ্ববর্তী সাইক্লোন শেল্টারে সন্ধ্যার পর থেকে ভিড় করেন। এ সময় নদীগুলোতে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। সকালে জোয়ারের চাপে বেতাগী উপজেলার কমপক্ষে ১২টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে গ্রামের কয়েক হাজার কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জোয়ারের পানি পাকা সড়ক উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় বেশ কিছু সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তলিয়ে যায় ফসলের ক্ষেত।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ বলেন, রেমালে উপজেলায় পাঁচ সহস্রাধিক কৃষক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এতে অন্তত ৫০০ হেক্টর জমির ফসল জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার হেক্টর আউশের বীজতলাসহ, পান, সুপারি, ফল, কলা বাগান ও শাকসবজি ক্ষেতসহ আরও ৫০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে কত টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করা যায়নি।

বেতাগীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও বিপুল শিকদার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে কাঁচাঘর, রবিশস্য, সড়ক ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে অনেক গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ দ্রম্নত মেরামতের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।

তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, বরগুনার তালতলীতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তছনছ হয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকা। ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে গত রোববার সন্ধা থেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন মানুষ। এরপর টানা কয়েক ঘণ্টার রেমালের তান্ডবে এ উপজেলায় ৬৫০টি ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঝড় শেষ হওয়ার প্রায় ৩৬ ঘণ্টার পরেও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়া পরিবারগুলোর প্রায় ৫ হাজার মানুষ বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। এদিকে বাড়িঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত ও পানিবন্দি থাকায় আশ্রয় কেন্দ্রেই থাকতে হচ্ছে তাদের। উপজেলার একাধিক আশ্রয়ণে ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।

গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন স্থানীয় সরকার উপপরিচালক মো. তানজিম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিফাত আনোয়ার তুমপা। ঝড় শেষ হওয়ার প্রায় ৩৬ ঘণ্টার পরেও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় বাড়িতে ফিরতে না পারা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন তারা।

আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, গত রোববার আশ্রয় কেন্দ্রে আসেন রোকেয়া বেগম। তবে প্রথমে ঘরেই থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঝড়ের প্রভাব ও পানি বাড়তে থাকায় ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রাতেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জয়াল-ভাঙা সাইক্লোলন সেল্টারে আশ্রয় নেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ থাকায় খালি হাতেই ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। পরের দিন ঝড় থামলেও ঘড়-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। অন্য দিকে বাড়ির চারপাশে অথই পানি থাকায় পরিবার নিয়ে ওই আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকছেন তিনি।

জয়ালভাঙা সাইক্লোলন সেল্টার আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে রোকেয়া বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, 'রাতের বাতাসে ঘর-বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বাড়ির চারদিকে পানি থই থই করছে। এখন হাতে টাকাপয়সা নাই। কোথাও থেকে ধার আনতে হবে নতুর ঘর তৈরির জন্য। ঘর যত দিনে না তৈরি করতে পারব ততোদিন এখানেই থাকতে হবে।'

রেমালের প্রভাবে পানিবন্দি হওয়া নলবুনিয়া আশ্রয় কেন্দ্রে এলাকার প্রায় শতাধিক পরিবার আশ্রয় নেয়। এসব পরিরাবের পুরুষের বেশির ভাগই জেলে। কেউ কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন ও রিকশা চালান। তাদের অনেকের বাড়িঘর পানিবন্দি হয়ে আছে। কারও কারও ঘর পুরো ভেঙে পড়েছে। কারও ঘরের বেড়া, মেঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের আসবাব, কাপড়চোপড় পানিতে ভেসে গেছে। তাই তারা বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

ফকিরহাটের সকিনা আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ পরিবার এখনো বাড়িতে ফেরেনি। ৫টি কক্ষে আছেন এসব পরিবারের সদস্যরা। কেউ মেঝেতে শুয়ে আছেন, অন্য কক্ষে বেঞ্চ দিয়ে ভাগ করে থাকছে বাড়িঘর হারানো পরিবার। প্রশাসন থেকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। সেগুলোর উপরই চলছে তাদের পরিবার।

ছোটবগী এলাকার আজিজ হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, 'আমার বাড়ি-ঘরসহ ভাইদের ঘরে গাছ পড়ে একদম শেষ। তাছাড়া এখনো পানিতে সেই বাড়ি তলিয়ে রয়েছে। ঘর থেকে পানি নামলেও এখনই যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘরের একদিক ধসে পড়েছে। আসবাবপত্র সব পানিতে ভেসে গেছে। ঘরে কোনো জিনিসপত্রের ঠিক নেই। তাই নতুন ঘর তৈরি করে বাড়িতে যেতে হবে।'

মাজেদা বেগম বলেন, 'ঝড় গেছে একদিন হয়ে গেছে। এখনো পানিবন্দি হয়ে আছি। এখানে থাকা তো খুবই কষ্টের। পানি কমলেও ঘরের ভেতরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিফাত আনোয়ার তুমপা বলেন, ৫৩টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার মানুষ রয়েছেন। একদিকে পানিবন্দি, অন্যদিকে বিধ্বস্ত বাড়িতে ফিরতে পারছেন না তারা। এই মানুষের খাবারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে প্রশাসন থেকে।

দাকোপ (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে খুলনার দাকোপে বিভিন্ন নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩১ নম্বর পোল্ডারের পৃথক ৭টি স্থানে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। ভাঙন কবলিত ৫টি স্থানে বাঁধ আটকাতে সক্ষম হলেও বাকি দুটি স্থানে বাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। বাঁধ আটকালেও ওই সব স্থানগুলো রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। ফলে এলাকার হাজারো মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে ভাঙন কবলিত স্থানগুলো পরিদর্শন করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ননী গোপাল মন্ডলসহ আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ ও ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বিভিন্ন নদ-নদীতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩১ নম্বর পোল্ডারের উপজেলার কামিনীবাসিয়া ভোলা মেম্বারের বাড়ির কাছে ৮০ ফুট, কামিনীবাসিয়া পুরাতন পুলিশ ক্যাম্পের পাশে ৬০ ফুট, বটবুনিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে ২০ ফুট ও ৫০ ফুট, পানখালী ফেরিঘাটের পূর্ব পাশে সাইক্লোন সেন্টারে কাছে ২০ ফুট, খলিশা স্স্নুইচ গেট সংলগ্ন ৩০ ফুট ও লক্ষ্ণীখোলা খেয়াঘাটের সামনে ২০ ফুট পৃথকভাবে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এছাড়া আরও কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে পানি উপচেপড়ে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কামিনীবাসিয়া, বটবুনিয়া, পানখালী, খলিশা এলাকা পস্নাবিত হয়ে অসংখ্য মৎস্য ঘের ও পুকুর তলিয়ে কয়েক লাখ টাকার মাছ ভেসে যায় এবং ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বটবুনিয়া এলকার প্রণব কবিরাজ জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বটবুনিয়া বাজারের পাশে পৃথক দুটি স্থান ভেঙে এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এতে অনেকের পুকুর ডুবে অনেক টাকার মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া বাড়ি ঘরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এমনকি গবাদিপশুও বিলে চরাতে পারছে না। বর্তমানে একটি বাঁধ আটকানো হয়েছে এবং অপরটির কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু এখনো ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। টেকসই বেড়িবাঁধ না দিতে পারলে আবারো পস্নাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। একই অভিমত ব্যক্ত করেন, কামিনীবাসিয়া এলাকার আছাবুর সরদার ও পানখালী এলাকার ফাল্গুনী হালদার।

পানখালি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ সাব্বির আহমেদ বলেন, 'পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় পানখালী ও লক্ষ্ণীখোলা এলাকায় স্থানীয়দের নিয়ে বাঁধ মেরামত করতে পেরেছি। এছাড়া খোনা মোল্যা বাড়ির সামনে কিছুটা ওয়াপদা রাস্তা ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।'

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, রেমালের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণ পানি ঢুকে গোটা উপজেলায় ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকার কৃষি ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার বলেন, ঝড়ের প্রভাবে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৫৬০টি ঘের ও পুকুর তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এতে ৩৩ কোটি ৮৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শেখ আব্দুল কাদের জানান, ঝড়ের প্রভাবে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৮৫০২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ১৬ হাজার ৯০৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ৬ কি.মি. ওয়াপদা বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া ২৫,৪০৭টি পরিবারের এক লাখ ২২ হাজার ৩০২ জন মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

এ ব্যাপারে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ভেঙে যাওয়া সবগুলো স্থানে বাঁধ আটকানো হয়েছে। তবে কামিনীবসিয়া এলাকায় একটি বাঁধ আটকানোর পর পুনরায় নদীর জোয়ারের পানির চাপে ভেঙে গেছে। পরবর্তী ভাটায় আবার আটকানোর চেষ্টা করা হবে।

উজিরপুর (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সন্ধ্যানদী সংলগ্ন পৌর এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবং নিম্নাঞ্চল হওয়ায় জোয়ারের পানিতে পস্নাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ সবক'টি ইউনিয়নই ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে পস্নাবিত হয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দুর্যোগ উপেক্ষা করে ছুটে যান পৌর মেয়র ও উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন বেপারী।

পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রিপন মোলস্না জানান, এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা বাড়িঘর পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। ঘেরের মাছ ভেসে গেছে, বিভিন্ন প্রকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সাতলা, হারতা, জলস্না, ওঠরা, বরাকোঠা, শোলক, বামরাইল, শিকারপুর, গুঠিয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন শাক-সবজি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও বিদু্যৎসংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে