বারোমাসি লেবু চাষে অনুপ্রেরণা কালীগঞ্জের সোহান

দেবীগঞ্জে মালচিং পেপার পদ্ধতিতে মরিচ চাষ

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০

পঞ্চগড় প্রতিনিধি
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে বারোমাসি লেবু বাগান -যাযাদি
দেশে কৃষিতে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মালচিং পদ্ধতি। বাণিজ্যিকভাবেও এর প্রসার ঘটছে। পঞ্চগড়ে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে মরিচ চাষেও যুক্ত হয়েছে মালচিং পদ্ধতি। দীর্ঘ সময় ফলন এবং বাজারে সারা বছর চাহিদা থাকায় মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার অনেকেই এখন এই পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করছেন। মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষে খরচ অনেক কম। এ ছাড়া এ পদ্ধতিতে আগাছা হয় না বলে তা পরিষ্কারের কোনো ঝামেলা নেই। দফায় দফায় সার দেওয়ারও ঝামেলা নেই। আর গাছ দীর্ঘজীবী হওয়ায় উৎপাদন হয় দীর্ঘসময় ধরে। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করে আশানুরূপ লাভবান হন তিনি। সেলফ-হেল্প অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন প্রোগ্রাম-শার্প'র কৃষি কর্মকর্তা মেহবুব-উল সহিদ বলেন, এ পদ্ধতিতে জমি তৈরির জন্য মাঝখানে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। বেডগুলো ঢেকে দেওয়া হয় মালচিং পেপার দিয়ে। পস্নাস্টিকের মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচের দিকে আর রুপালি রঙের দিকটা থাকে ওপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। এ পদ্ধতিতে সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের উপযোগী। পরে মালচিং পেপারের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল গোল করে কেটে নেওয়া হয়। এরপর কেটে নেওয়া জায়গায় রোপণ করা হয় বীজ বা চারা। এরপর তিন ফুট উঁচুতে বাঁশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে দীর্ঘ সময় ধরে ফলন পাওয়া যায় এবং কৃষকরা অধিক লাভবান হন। দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক মাহাবুল ইসলাম বলেন, এবার মালচিং পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছেন। ফলন খুব ভালো হয়েছে। মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ দেখতে অনেকেই তার জমিতে আসছেন। এ পদ্ধতিতে তেমন খরচ নেই। লাভও বেশি হয়। পিকেএসএফের অর্থায়নে এবং শার্প'র সার্বিক সহযোগিতায় পরিবেশবান্ধব মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করে দেবীগঞ্জের অনেক কৃষক লাভের মুখ দেখছেন। কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের মো. মোনাব্বরের ছেলে সোহান পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তবে কৃষি তার শখের জায়গা। শখের বসেই করেছেন বারোমাসি লেবু বাগান। এখন তিনি সফল একজন লেব চাষি। তাকে দেখে এগিয়ে আসছেন আশাপাশের অন্য বেকার যুবকরাও। কথা হয় সোহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমি যার কাছে ইলেকট্রিক কাজ শিখতাম তার সাড়ে ৮শ' টাকা মজুরি বাকি ছিল। তিনিও কাজের পাশাপাশি বারোমাসি বিভিন্ন জাতের লেবু চাষ করতেন। আমার কাজের মজুরি বাদবাকি টাকা দিতে দেরি হওয়ায় পাওনা টাকার পরিবর্তে ওই পরিমাণ ২০টি লেবু চারা দিতে বলি। তিনি আমাকে ৩ জাতের ২০টি লেবু চারা দেন। সেটা ২০১৭ সালের কথা। পরে আমি স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে ২০টি বারোমাসি লেবু চারা নিয়ে ৫ শতক জমিতে লেবু চাষ শুরু করি। এখন আমার বাগানে আছে ৯ জাতের ৫০টিরও বেশি বারোমাসি লেবু গাছ। বারোমাসি লেবু ছাড়া যেসব লেবু চারা আমার বাগানে ছিল আমি সেগুলো কেটে ফেলেছি। এখন আমার বাগানে শুধু বারোমাসি লেবুর বিভিন্ন জাতের গাছ রয়েছে। অসময়ে লেবু বিক্রির পাশাপাশি চারা বিক্রি করে আলহামদুলিলস্নাহ অনেক ভালো আছি। আমার বাড়ির ও গ্রামের আশপাশের প্রতিবেশী ও বেকার যুবকরাও আমার কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে লেবু চাষ শুরু করেছেন। সোহান আরও বলেন, 'ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এ লেবুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তখন প্রতিটি লেবু ৭ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করি। ওই ৩ মাসে আমার বাগানের লেবু বিক্রি করে ভালো টাকা আয় হয়। তাছাড়া অফ সিজনে এক হালি লেবু ৩-৪শ' টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পাশাপাশি লেবু কাটিং বিক্রি করেও ভালো আয় হয়। বাগানে এসে পাইকাররা নগদ টাকায় লেবু কিনে নিয়ে যায়।' জানা গেছে, কলম্বো, কাগজি, হাইব্রিড কাগজি, গোল কাগজি, সিডলেস, চায়না থ্রি, গন্ধরাজ, জারা ও এলাচি জাতের বারোমাসি লেবু চাষে বাজিমাত করেছেন সোহান। প্রতিদিন পাইকাররা তার বাগান থেকে বিভিন্ন জাতের লেবু কিনে নিয়ে যায়। এ লেবু গাজীপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। এছাড়া মাঝে মধ্যে তার বাগানের মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও পার্সেল যায়। ষাটোর্ধ্ব শিক্ষক মিজানুর রহমান মোড়ল বলেন, সোহান যে বারোমাসি লেবু চাষ করে সেটা অফ সিজনে প্রচুর দাম থাকে। এছাড়া সিজনেও ভালো বিক্রি হয়। এ লেবুতে প্রচুর ঘ্রাণ ও রস আছে। তার এ লেবু চাষ দেখে আশপাশের বেকার যুবকরাও এগিয়ে আসবে। পঁচিশোর্ধ্ব সৌদি ফেরৎ শাহিন মিয়া বলেন, 'আমি সাড়ে ৪ বছর সৌদি আবরে ছিলাম। এখন দেশে ফিরে সোহানের লেবু বাগানের কথা শুনে দেখতে আসলাম। আমিও একটি লেবু বাগান করতে আগ্রহী। সোহান ভাইয়ের কাছ থেকে তিন জাতের কিছু চারা নিয়ে এক একর জমিতে লেবু চাষ শুরু করব। লেবু বাগান করতে চারা ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবেন বলে সোহান আমাকে কথা দিয়েছে।' কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, 'সোহান আমাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় লেবু বাগান করেছেন। ৮ বছর আগে ৩ জাতের বারোমাসি ৩ জাতের লেবু চাষ শুরু করেন। এখন তিনি একজন সফল লেবু চাষি। আমরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। সোহানের লেবু বাগান থেকে প্রচুর আয় হচ্ছে। তার দেখাদেখি অনেকেই এখন লাভজনক এ বারোমাসি লেবুর চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।'