গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার ভাংনাহাটির দক্ষিণে তালুকদার ভিটায় মাদক সেবনের জেরে দুইপক্ষের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ছুরি দিয়ে মারামারির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হয়। এদিকে গাজীপুর ইউনিয়নে নেশার টাকার জন্য মায়ের হাতের রগ কেটে দেয় সন্তান। অন্যদিকে ঈদের দাওয়াতে নিয়ে পৌর এলাকার বহেরারচালায় মাদকের জেরে লতিফ নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সবশেষে ২১ মে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেপিরবাড়ি মাটির মসজিদ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারের জেরে ফরহাদ নামের এক কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। কিশোরদের এসব বেপরোয়া অপরাধের পেছনে সর্বোপরি হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। বর্তমানে এ উপজেলায় শিশুকিশোরদের মধ্যে মাদক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় উদ্বেগ প্রকাশ হয়।
ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সমাজসেবকদের দেওয়া তথ্য মতে, শ্রীপুর পৌর শহরের রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশে, ভাংনাহাটি ও লোহাগাছ গ্রামের মধ্যভর্তি এলাকার ফালুমার্কেট, তালুকদারভিটা, বেড়াইদের চালার আসপাড়া মোড়ের পশ্চিমে কিচ্ছাবাড়ি, বহেরারচালা, মাওনা চৌরাস্তা, উজিলাব মারকাপের মোড়, উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ, মাওনা ইউনিয়নের অবদার মোড়, চকপাড়া, বরমী ইউনিয়নের কেন্দুয়া, সাতখামাইর, কাওরাইদ ইউনিয়নের বেলদিয়া, মধ্যবাজার হিন্দুপট্টি, রাজাবাড়ির, নার্সারির মাঠ, বিন্দুবাড়ি, জিউসি, গোসিংগা ইউনিয়নের খোজেখানী, বাউনি, প্রহলাদপুর ইউনিয়নের মারতা, গাজীপুর ইউনিয়নের বাঁশবাড়ি ও কাওরাইদ ইউনিয়নের বেলদিয়ার একাধিক স্থানে দিন-রাত চলে মাদকের রমরমা বাণিজ্য।
দীর্ঘদিন ধরে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তেলিহাটি ইউপি মেম্বার তারেক হাসান বাচ্চু। তিনি বলেন, এই ইউনিয়নের মাদকের ছড়াছড়ি এখন উন্মুক্ত রহস্য। অনেক সময় পুলিশ ওদের ধরলেও অদৃশ্য কারণে ছেড়ে দিচ্ছে। তেলিহাটি ইউনিয়নের গোদারচালা এলাকার মাদককারবারি জাহাঙ্গীর সরকারকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ ধরে পুলিশ। তারপরও ওই এলাকায় মাদক থামেনি।
কাওরাইদ ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ বলেন, 'বর্তমানে না বুঝে মাদকের সঙ্গে শিশু-কিশোররা বেশি জড়িয়ে পড়ছে। আমার ইউনিয়নের সীমান্তের কয়েকটি স্থানে মাদকের ছড়াছড়ি মাত্রারিক্ত। এছাড়াও কাওরাইদ বাজারের কয়েকটি স্পট আছে।'
প্রহলাদপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, 'গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সীমান্ত ও শ্রীপুরের প্রহলাদপুরের বাশকোপা গ্রামের শেরালিয়া বাড়িঘাটপাড়, মারতা গ্রামের চরমাখাপাকা ব্রিজ, বাঘাইব্রিজ এলাকা, ফাওগাইন বাজার, আতলরাগান্ধী বাড়ি চৌরাস্তায় মাদকের ছড়াছড়ির বিষয়ে প্রশাসনকে অবগত করেছি।'
মাদকের বিরুদ্ধে মাইকিংয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেও প্রতিরোধে ক্লান্ত গাজীপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মাদবর। তিনি বলেন, 'ভালুকার কাচিনার সীমান্ত নিয়ে আমার ইউনিয়নে বাঁশবাড়ি মধুমার্কেটে মাদক আসে। সেখানে ওপেন কেনাবেচা হয়। এছাড়াও আমার এলাকার কয়েকটি স্থানে মাদকের ছড়াছড়ি রয়েছে যা থানায় অবগত করেছি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপপরিচালক এমদাদুল হক বলেন, গাজীপুরের মাদকাসক্তদের প্রতি ২০ জনের মধ্যে ৫ জনই শিশুকিশোর। যাদের অধিকাংশ গাঁজা সেবন করে। শিল্পায়নের ফলে বাবা-মার চাকরির সুবাদে শিশুকিশোরদের নজর কম, বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, হতাশা, অতিরিক্ত রাগ-জেদ, সমাজের প্রতি বিরক্তি, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা, অভিভাবকরা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য ও ব্যাপক স্বাধীনতা। যা সন্তানকে করে তোলে বেপরোয়া, ও অপরাধী। নিয়মিতই নতুন শিশু যোগ হচ্ছে।
শ্রীপুর থানার ওসি আকবর আলী খান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযান চলছে। গত ২ মাসে ১৫টি মামলায় আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং নির্মূলে কাজ করছে পুলিশ।
ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, উত্তরের সীমান্ত ঘেষাঁ উপজেলা নীলফামারীর ডিমলায় গড়ে উঠেছে ভয়াবহ মাদকের অভয়ারাণ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। এতে দিনদিন ধ্বংসের পথে যাচ্ছে শিশু-কিশোররা। চুরি ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্ম বেড়েই চলছে এ উপজেলায়।
প্রতিদিন সকাল হতে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত ডিমলা উপজেলা সদরের বিশেষ করে থানার আশপাশ এলাকার শিবমন্দির পাড়া, পোস্ট অফিস মোড়, টিঅ্যান্ডটি রোড, মেডিকেল মোড়সহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এমন কি গ্রাম অঞ্চলেও প্রকাশ্যে মাদককারবারিরা হিরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশাজাত দ্রব্যের রমরমা মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে সহজলভ্য মাদক। যার কারণে বিশেষ করে ১২ বছর থেকে ১৬ বছর বয়সি শিশু কিশোরেরা মাদক সেবনে আসক্ত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বাড়িতে অভিভাবকদের সঙ্গে মাদকের টাকা না পেয়ে দুর্ব্যবহার করছে ও টাকা জোগাতে সমাজবিরোধী বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলার তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় ভুক্তভোগী অভিভাবকরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন।
ডিমলা উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অন্যতম সদস্য আবু সায়েম সরকার বলেন, 'উপজেলায় মাদকের করাল গ্রাসে যুবসমাজ ও শিশুকিশোর ধ্বংসের দারপ্রান্তে। অবৈধ এই মাদকের ছড়াছড়ি উপজেলাজুড়ে হলেও ডিমলা সদরেই বেশি। আমি এই মাদকের বিষয়ে ডিমলা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। কমে আবার বাড়ে। ডিমলা পরপর দুটি ধর্ষনের ঘটনা, চুরি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে এই মাদকসেবীরাই জড়িত। তাদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির দাবি করছি।'
ডিমলা থানার ওসি দেবাশীষ রায়ের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে ওসি (তদন্ত) আব্দুর রহিম বলেন, প্রতিদিন থানা পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে মাদককারবারিদের গ্রেপ্তার করে নিয়মিত মামলা রুজু করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হচ্ছে।