শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

মেহেরপুরে পরিত্যক্ত জায়গা কাজে লাগিয়ে সবজি চাষ

হোসেনপুরে গ্রিন হাউস পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম ফুলবাড়ীতে মাচা পদ্ধতিতে চাষে বাজিমাত
স্বদেশ ডেস্ক
  ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০
মেহেরপুরে পরিত্যক্ত জায়গায় গড়ে তোলা সবজি বাগান -যাযাদি

মেহেরপুরে পরিত্যক্ত জায়গায় সবজি চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। এদিকে, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে গ্রিন হাউস পদ্ধতিতে লাল-হলুদ ক্যাপসিকাম চাষ করে বাজিমাত করেছেন কৃষক। অন্যদিকে, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে মাচা পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে নানা জাতের তরমুজ। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্র্ট-

মেহেরপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেহেরপুর সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টার আঙ্গিনায় পরিত্যক্ত জায়গায় চাষ করা হয়েছে বিষমুক্ত প্রায় ২০ রকমের শাক-সবজি। ফলনও হয়েছে আশানুরূপ। পরিত্যক্ত জায়গায় ভালো ফলন ও সবুজ শ্যামল মনোরম পরিবেশ তৈরি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান খান। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এমন উদ্যোগে প্রশংসিত হচ্ছেন তিনি। আর চাষকৃত সবজি দিয়ে পুলিশ লাইনের মেসসহ পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে উপহারস্বরূপ বিতরণও করছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশে উদ্বুব্ধ হয়ে পুলিশ লাইনের প্রায় এক একর (তিন বিঘা) পরিত্যক্ত জায়গা পরিষ্কার করে প্রায় ২০ রকমের সবজির ক্ষেত তৈরি করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান খান। পুলিশ লাইনের জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরেই পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু সেই পরিত্যক্ত জায়গায় সবজি বাগান করার কারণে আঙ্গিনার রূপ বদলে গেছে। এমন উদ্যোগে পরিত্যক্ত জমিতে চাষাবাদে অন্যদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

বাগান ঘুরে দেখা গেছে, তিনি রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার, কীটনাশকের পরিবর্তে স্ট্রিপ ফেরোম্যান ট্র্যাপ ব্যবহারে পোকামাকড় দমন, পরিকল্পিত উপায়ে লাইন ও নালা করে আগাছা দমন, পানি নিষ্কাশন, সার ও সেচ দিয়ে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন। লাইন ধরে শোভা পাচ্ছে, পেঁপে বাগান, বেগুন, মরিচ, টমেটো, ঢেঁড়স, পাতাকপি, ফুলকপি, লালশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক, পালংশাক, মাচাতে শোভা পাচ্ছে ঝিঙ্গে, চিচিঙ্গে, বরবটি, কালো তরমুজ, লাউ, পটল, শশাসহ নানা জাতের সবজি। পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়মিত রুটিং দায়িত্ব পালন শেষে অযাচিত বাইরে ঘোরাফেরা না করে নিজেরাই কাজ করছেন এই সবজি ক্ষেতে।

ক্ষেতে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জানান, সপ্তাহে ৬০-৬৫ কেজি বেগুন, ২৫-৩০ কেজি করে ঢেঁড়স, কাঁচামরিচ, বরবটি, ঝিঙ্গে, ৩০-৪০টি লাউ, তরমুজসহ অন্য শাকসবজি প্রয়োজন মতো উত্তোলন করা হচ্ছে। এই সবজি নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি উদ্ধৃত্ত সবজি অন্যদেরও দেওয়া হচ্ছে। সবজি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারাও খুশি।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা চায়না পারভিন জানান, পুলিশ লাইনের পরিত্যক্ত জায়গায় সবজি চাষ, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। বাড়ির আঙ্গিনাসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গায় সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদে কৃষি বিভাগ সব সময় সহযোগিতা করে আসছে। এখানেও কৃষি বিভাগ থেকে সার, বীজসহ বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে। বিভিন্ন অফিস প্রাঙ্গণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় পরিত্যক্ত সবজি আবাদে আগ্রহী করতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান খান জানান, 'মেহেরপুর পুলিশে যোগদান করে দেখি, পুলিশ লাইনে ব্যাপক অনাবাদি জমি পড়ে রয়েছে। গণমাধ্যমে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সবজি বাগান, মাছ ও গবাদিপশু পালন করছেন। সরকারি কর্মকর্তা বা অতিথিরা গেলে নিজ হাতে সবজি উঠিয়ে উপহার দিচ্ছেন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি এই সবজি বাগান করার সিদ্ধান্ত নেই। কৃষি বিভাগ ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আজকের এই সাফল্য। আন্তরিকতা থাকলে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ঘরবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় এমন সবজি বাগান গড়ে তোলা সম্ভব।

হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের পুমদী ইউনিয়নের নারায়ণ ডহর গ্রামের বাসিন্দা এখলাস উদ্দিন সবুজ (৩৮)। রাজধানী ঢাকার কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। পড়াশোনা শেষ করে হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী। শুরু করেছিলেন মাছের রেনু থেকে পোনা উৎপাদন। পরে এক কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে হয়েছেন পুরোদস্তুর কৃষক। বেকারত্ব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

এখলাস উদ্দিন সবুজ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় পলিনেট হাউস প্রর্দশনী বাস্তবায়নে পলিনেট হাউসে উচ্চমূল্য ফসল ক্যাপসিকাম আবাদ করে লক্ষাধিক টাকা আয় করেছেন। তবে স্থানীয়ভাবে ক্যাপসিকাম বিক্রি না করতে পেরে কিছুটা বিপাকেও পড়েছেন।

সরজমিন দেখা যায়, প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম। অধিক ফলনের আশায় ক্যাপসিকাম ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক এখলাস উদ্দিন সবুজ। তার হাতের যত্ন আর পরিচর্যায় ক্যাপসিকামের চারাগুলো হয়ে উঠেছে হৃষ্টপুষ্ট।

এখলাস উদ্দিন সবুজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, 'আমি আধুনিক প্রযুক্তিতে মার্চিং পেপার দিয়ে টমেটো চাষ করে সাফল্য পাওয়ায় উপজেলা কৃষি অফিস পলিনেট হাউম উপহার দেয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পে আমি চুক্তিবদ্ধ হই যে, এই শেডে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করব। শুধু ক্যাপসিকাম করতে হবে, তা না।'

সবুজ বলেন, '২০২৩ সালের জুন মাসে শেড করা শেষ হয়, কিন্তু ঠিকাদার পানি সাপস্নাই, ফগার ইত্যাদি সেটিং না করাতে ডিসেম্বরে শেড চালু হয়। পরে ডিসেম্বর মাসে বগুড়ার এগ্রো ওয়ান কোম্পানি থেকে ২২ টাকা করে এক হাজার ১৪০টি ক্যাপসিকাম চারা কিনি। শেডের ভেতর ১০ শতাংশ জমিতে চারাগুলো রোপণ করি। দুই মাস পর থেকেই গাছে ফল আসা শুরু হয় এবং বিক্রিও করি। তবে সম্প্রতি কালবৈশাখী ঝড়ে ৪০টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ক্যাপসিকাম একটি বৈশ্বিক সবজি। এটাকে মিষ্টি মরিচ নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বড় বড় শহরের আশপাশে সীমিত পরিসরে কৃষকরা এর চাষ করে থাকেন। যা অভিজাত হোটেল ও বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটে বিক্রি হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও প্রচুর। কারণ সারা বিশ্বে টমেটোর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি এখন ক্যাপসিকাম।

পুষ্টিমানের দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান সবজি বলে পুষ্টিবিদদের অভিমত। তাদের মতে, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন' সি' রয়েছে এবং অতি সহজেই চাষ করা যায়। তাই দেশের জনসাধারণকে ক্যাপসিকাম চাষের জন্য উদ্বুব্ধ করা যেতে পারে।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুস সাত্তার বলেন, 'ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের একটি নতুন ফসল। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এ কে এম শাহজাহান করির বলেন, 'আমি বিভিন্ন সময় তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। বাজারে দাম ও চাহিদা ভালো হওয়ায় এই উপজেলায় আগামীতে ক্যাপসিকামের চাষ আরও বাড়বে বলে আশা করছি।' পুমদী ইউনিয়নের বস্নক সুপারভাইজার আলমগীর হোসেন জানান, 'আমি নিয়মিত সবুজকে সার্বিক সহযোগিতা করছি।'

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, গ্রীষ্মের শরবত বলে পরিচিত নদীর চরাঞ্চলের জনপ্রিয় ফসল তরমুজ এখন মাচা পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে। এই অঞ্চলে মাচা পদ্ধতিতে এতদিন লাউ, ঝিঙা চাষ হলেও, এখন একই পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে তরমুজ।

বাঁশের মাচায় সবুজ পাতার ফাঁকে বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ, কালো, সবুজ রঙের তরমুজ, প্রতিটি তরমুজ বাঁধা রয়েছে নেট দিয়ে। এভাবেই মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করেছে উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের ভিমলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ। তিনি মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করে সফল হয়েছেন। শুধু আব্দুল হামিদই নয়, উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের সহায়তায় উপজেলার আটজন কৃষক এই পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের প্রদর্শনি করেছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খরিপ-১ মৌসুমে এ বছর প্রথমবার এক দশমিক ৬ একর জমিতে মাচা পদ্ধতিতে তৃপ্তি, অনুভব ও বস্নাক বেবি জাতের তরমুজ চাষ প্রদর্শনি করা হয়েছে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকার আটজন কৃষক, ২০ শতক করে জমিতে এই প্রদর্শনি করেছেন। এই তরমুজ চাষে কৃষকদের বীজ, জৈব সার, জৈব বালাইনাশকসহ সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ফসল পরিচর্যার জন্য প্রতিটি কৃষককে তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হবে।

এদিকে প্রদর্শনি ছাড়াও নিজ উদ্যোগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তরমুজ চাষ করে সফল হয়েছেন অনেক কৃষক। তরমুজ চাষি ভিমলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ ও হামিদুল হক জানান, উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের সার্বিক সহায়তা এবং পরামর্শে তারা তরমুজ চাষ করেছেন, ফলনও ভালো হয়েছে। ইতোমধ্যে তরমুজ বড় হতে শুরু করেছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই এগুলো বাজারজাত করতে পারবেন।

কৃষকরা বলেন, তরমুজ চাষে ঝামেলা নেই, প্রথমে মাটি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। চারা গজালেই বাঁশ দিয়ে মাচা করে একটু পরিচর্যা করতে হয়। এরপর পুরো মাচায় ধীরে ধীরে গাছের লতায় ছেয়ে যায় ও ফল আসতে শুরু করে। ফলগুলো বড় হতে শুরু করলে সেগুলো নেট দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। কৃষকরা বলেন, গাছ লাগানোর তিন মাসের মধ্যে তরমুজ বাজারজাত করা যায়। তাদের দেখাদেখি অনেকেই তরমুজ চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

এদিকে ভিমলপুর মাঠে তরমুজ প্রদর্শনী পরিদর্শ করেন দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের জেলা প্রশিক্ষক জাফর ইকবালসহ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক রাকিবুজ্জামান, মনিটরিং ও ইভালুয়েশন কর্মকর্তা মশিউর রহমান। এ সময় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার, অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা শাহানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শন শেষে সেখানে তাদের উপস্থিতিতে স্থানীয় কৃষকদের তরমুজ চাষে উদ্বুব্ধকরণ ও নিরাপদ সবজি চাষের লক্ষ্যে মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে