ভরা মৌসুমে আমদানি
ধানের বাজার ব্যবসায়ীদের দখলে লোকসানের গ্যারাকলে চাষিরা
প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০
বরেন্দ্র অঞ্চল (নওগাঁ) প্রতিনিধি
ধান আর আমে সমৃদ্ধ দেশের খাদ্যভান্ডার বলে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁ। শেষ মুহূর্তে জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে চলছে বোরো ধান কাটার উৎসব। সকালে সূর্য ওঠার আগেই মাঠে ছুটছেন চাষিরা। কেউ ধান কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন। ভ্যান, ট্রলিসহ বিভিন্ন বাহনে করে কৃষকরা ক্ষেত থেকে ধান তুলে বাড়ির উঠোনে মাড়াইয়ের কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ সার, কীটনাশক, সেচ, হাল ভাড়াসহ উৎপাদন খরচ মিটাতে নতুন ধান বিক্রির জন্য হাট-বাজারে তুলছেন। ধানকাটা-মাড়াই, বাছাই আর বিক্রি নিয়ে মহাব্যস্ত কৃষক-কৃষানি।
তবে ফলনে খুশি হলেও দামে সন্তুষ্ট নন তারা। বাজারে গিয়ে চাষিদের হাসি হচ্ছে মলিন। চলতি মৌসুমে ধান হাটে উঠার পর থেকে দাম উঠানামা করছে। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে হাটে অনেক কম দামে মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে। সরকারি দরে বিক্রি করতে না পেরে হতাশ কৃষকরা। এবারও লোকসানের গ্যারাকলে পড়েছেন ধান চাষিরা। বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কৃষকরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দামবৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনে চাষাবাদে বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন তারা। পাচ্ছেন না ন্যায্যমূল্য। বছরজুড়ে বাজার থাকছে ব্যবসায়ীদের দখলে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় চাল কলের মালিক, প্রভাবশালী মজুতদার সিন্ডিকেট ও করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে বাজার। তাই দিন দিন কমছে ধানের দাম। আগামীতে আরও দরপতনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরা মৌসুমে চাল আমদানির প্রভাবে বাজারে কমছে ধানের দাম। এতে ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত চাষিরা।
সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল বেসরকারি পর্যায়ে সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য বরাদ্দ দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ শাখা। এতে পাঁচটি শর্তে সর্বোচ্চ শতকরা ৫ শতাংশ ভাঙাদানা বিশিষ্ট ৯১ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল ও ৩৩ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি পায় নির্বাচিত ৫০টি প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গছে, ধান রোপণ থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই পর্যন্ত বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ফলন হচ্ছে ২২ থেকে ২৪ মণ। মৌসুমের শুরুতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা। এ বছর মৌসুমের শুরু থেকে প্রকৃতিতে তীব্র তাবদাহ ও খরা বইছে। ফলে জমিতে ঠিকমতো পানি সেচ দেওয়া যায়নি। এছাড়া হয়েছে পোকার উপদ্রব। এতে করে বিঘাপ্রতি তিন থেকে চার মণ ফলন কমেছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ১ লাখ ৯১ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য ১২ লাখ ৮৫ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন। এই পরিমাণ ধান থেকে ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টন চাল উৎপাদন হবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
মহাদেবপুর উপজেলার তেরোমাইল এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এ বছর আবহাওয়ার কারণে ধান উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি হয়েছে। আবার ধানের ফলনও কম। সরু জাতের ব্রি-৯০ ধান বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ টাকা মণ। যেখানে সরকার মোটা ধান ১২৮০ টাকা দাম বেঁধে দিয়েছে। এ ধান ১৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হলে কৃষকদের জন্য সুবিধা। কিন্তু আমাদের পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।'
একই উপজেলার গাহলি গ্রামের কৃষক প্রেমানন্দ বলেন, 'আমরা হাটে ধান বিক্রি করতে এসে ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। সরকারি দামের চেয়ে মোটা ধান অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করা প্রয়োজন।'
ধান ব্যবসায়ী জামান হোসেন বলেন, 'বিগত বছরে হাটে ধান কিছুটা বেশি কিনে মজুত করতে পারতাম। এজন্য দাম একটু বেশি ছিল। তবে এ বছর তা সম্ভব হচ্ছে না। যে পরিমাণ ধান কেনা হয়েছে তা চাল উৎপাদনের জন্য চালকলে পাঠানো হচ্ছে। মজুতবিরোধ অভিযানের ভয়ে বেশি করে ধান কিনে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। যদি মজুত করা সম্ভব হতো তাহলে ধানের দাম আরও ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বাড়ত।'
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, 'কৃষকরা হাট-বাজারে যে ধান নিয়ে আসেন তাতে, কিছুটা ভেজা, চিটা ও ধুলা-বালিযুক্ত। ভেজা ধান কেনার পর শুকানো হলে ওজনে কমে যায়। আবার সংরক্ষণ করাও যায় না। সরকার মোটা ধান ১২৮০ টাকা মণ ঘোষণা করেছে। আমরা বাজার থেকে ধান কেনার পর দেখা যায় সরকারি মূল্যের কাছাকাছি চলে যায়। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে কিনতে হয়। তবে সরকারি মূল্যে কেনা হলে পোষানো সম্ভব না। কারণ সরকারি গুদামে শুকনা ও ধুলা-বালিমুক্ত ধান দিতে হয়।'
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান বলেন, জেলায় ১৯ হাজার ২১৮ টন ধান, ৪৭ হাজার ৮১৫ টন সেদ্ধ চাল এবং ৪ হাজার ৬৫২ টন আতপ চালের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সরকারি মূল্যে দাম পেয়ে কৃষকরা লাভবান হবেন। তবে গুদামে ধান দিতে গিয়ে কৃষকরা যেন কোনোভাবে হয়রানি না হয়, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ বছর জেলায় ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যেখানে প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৪৫ টন হিসেবে ফলন হচ্ছে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।