নওগাঁয় পিআইও'র বিরুদ্ধে প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ

মসজিদ-মন্দিরের বরাদ্দে নয়ছয়

প্রকাশ | ২২ মে ২০২৪, ০০:০০

বরেন্দ্র অঞ্চল (নওগাঁ) প্রতিনিধি
নওগাঁর মহাদেবপুরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচিতে অনিয়ন-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) বিরুদ্ধে। সরকারি বরাদ্দের অর্থ পরিশোধে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। বিতরণ করা হয়েছে নগদ টাকা। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্যের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দকৃত অর্থে পিআইও'র কমিশন বাণিজ্য নিয়ে এলাকায় বইছে সমালোচনার ঝড়। চলছে নানা তর্কবিতর্ক। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক (৩য় পর্যায়) মহাদেবপুর উপজেলায় গত ৩ মার্চ 'বাজাসস/৪৮ নওগাঁ-৩/২০২৪/০৩৬' নম্বর ডিওতে প্রকল্প দাখিল করেন। এতে মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, কবরস্থান, ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স, উপজেলা পরিষদ অফিসার্স কোয়ার্টার সংস্কারসহ পৃথক ৬৬টি প্রকল্পের প্রত্যেকটিতে ৬০ হাজার টাকা করে মোট ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। অভিযোগ রয়েছে বরাদ্দের অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রকল্পের বিল পরিশোধের জন্য অফিস খরচ বাবদ শতকরা প্রায় ১২ শতাংশ হারে কমিশন কেটে রেখে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর থেকে নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে বরাদ্দপ্রাপ্ত ওই ৬৬টি প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা। সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স সংস্কারের জন্য ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সংস্কার কাজের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কমপেস্নক্সটির প্রাচীরসহ বিভিন্ন স্থান সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। টিআর প্রকল্পে বরাদ্দপ্রাপ্ত উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের রনাইল নিচপাড়া যুব ক্লাবে মেলেনি সংস্কার কাজের সন্ধান। ক্লাবের কার্যক্রমও সচল নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা দেখালেন রনাইল মাঠ সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত ইটের ঘর। নেই ছাদ বা টিনের চালা। ঘরের মধ্যে জঙ্গল আর ঘাসে ভরা। মহাদেবপুর ইউএনও'র কার্যালয় সংলগ্ন উপজেলা পরিষদ অফিসার্স কোয়ার্টার সংস্কারের জন্য বরাদ্দে নামমাত্র কয়েক ট্রাক্টর মাটি কেটে হালাল করা হয়েছে প্রকল্পের অর্থ। দৃশ্যমান তেমন কোনো সংস্কার চোখে পরেনি। দু'একটি ছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পের চিত্র প্রায় একই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে মহাদেবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন আবু বক্কার সিদ্দিক। এরপর প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে তোলেন নিজস্ব কমিশন সিন্ডিকেট। এর সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। প্রকল্প থেকে কমিশন আদায় করেন তারা। সিন্ডিকেটটির সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করে না কেউই। তবে বিষয়টি স্থানীয় সচেতন বাসিন্দাদের কাছে ওপেন সিক্রেট। এদিকে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী ওই সিন্ডিকেটের ব্যাপারে নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য, নওগাঁর জেলা প্রশাসক ও মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন উপজেলার বাসিন্দারা। দ্রম্নত আইন প্রয়োগের দাবি তাদের। মহাদেবপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স সংলগ্ন এলাকার আব্দুল করিম জানান, এটি নির্মাণের পর আর কোনো সংস্কার কাজ হয়নি। ভবনটি হস্তান্তরের পর থেকে এ পর্যন্ত এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি বা এক কড়াই সিমেন্টেরও কাজ হতে তিনি দেখেননি। একই কথা জানান আরও ১০-১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা। বরাদ্দপ্রাপ্ত রনাইল নিচপাড়া যুব ক্লাবের সভাপতি আইয়ুব আলী জানান, গত ঈদের আগে ক্লাব সংস্কারের জন্য কমিটি ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে বলে শুনেছেন। সেটি স্থানীয় নেতা শফিকুলের কাছে জমা রয়েছে। বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন করতে ক্লাবের কাউকে উপজেলায় যেতে হয়নি। রনাইল পূর্বপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, মসজিদ সংস্কারে এমপির টিআর কর্মসূচি থেকে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু অফিস খরচ শেষে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পেয়েছেন নগদ ৫৩ হাজার টাকা। বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন করতে ব্যাংকে যেতে হয়নি। সরকারিভাবে প্রতিটি প্রকল্পে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কর্মকর্তাদের কমিশন ও অফিস খরচ বাদে নগদ ৫৩ হাজার করে টাকা পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সংস্কারের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত খাতিজা দারুল উলুম ক্বওমী মাদ্রাসার মুহতামিম আব্দুল বারী, খাজুর পলিপাড়া দুর্গা মন্দিরের সভাপতি বিমল চন্দ্র, মর্ত্তুজাপুর মধ্যপাড়া জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক তায়েজ উদ্দিন, জোয়ানপুর কবরস্থানের সভাপতি এসএম আব্দুল মান্নান প্রমুখ। সম্প্রতি মহাদেবপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে সরকারি দপ্তরে একটি বৈঠকে প্রতিবেদকের কাছে কমিশন বাণিজ্য ও নগদ অর্থ বিতরণের কথা স্বীকার করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বক্কার সিদ্দিক। পরে সংবাদ প্রকাশের জন্য তার বক্তব্য জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, যা বরাদ্দ তাই প্রকল্পের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা তার দপ্তর থেকে নিয়ে গেছে। বিলের মাধ্যমে বরাদ্দের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে দাবি করেন এই সরকারি কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে নওগাঁ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আশেকুর রহমান জানান, সরকারি প্রকল্পে কমিশন আদায় ও নগদ অর্থ বিতরণের সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।