সুখের স্বপ্নের দেখা মেলেনি ৮০ বছরের দম্পতি সালেক উদ্দিন ও ইবেদা বেগমের। অত্যাধুনিক এই যুগে ঘরে ঘরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও প্রাচীন যুগেই পড়ে আছেন তারা। অর্থাভাবেই একটি গরুও কিনতে পারেনি তারা। যে কারণে এই দম্পতি কাঁধে জোয়াল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘানি টেনেই পার করছেন জীবনের দীর্ঘ সময়। ঠুলি পরা কলুর বলদ বিভিন্ন গ্রন্থে ও গল্পে থাকলেও বাস্তবে দেখা মিলল কাঁধে জোয়াল নিয়ে ঘুরতে থাকা দম্পতির অর্থাৎ কলুর বলদের কাজ করছেন জলজ্যান্ত মানুষ। কষ্টের সীমা নেই তাদের। তবে সমাজের কোনো বিত্তবান কিংবা জনপ্রতিনিধি অথবা সরকারি কোনো কর্মকর্তার চোখে কখনই পড়েনি।
বলছিলাম বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের মুদিপাড়া এলাকার সালেক উদ্দিন দম্পতির কথা। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় পাড় করতে হয় তাদের জোয়াল কাঁধে ঘুরতে ঘুরতে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে স্ত্রীকে নিয়ে ঘানি টানছেন সালেক উদ্দিন। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে ঘানি টানতে টানতে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তাদের। তবুও ঘানি টানতেই হবে, কারণ ঘানি না টানলে অন্ন জুটবে না।
সালেক উদ্দিনের বয়স প্রায় ৮০ বছর। স্ত্রী সন্তানদের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে যুগ যুগ ধরে এভাবে ষাঁড়ের বদলে নিজেই ঘানি টেনে চলেছেন। সঙ্গে থাকেন সহধর্মিণী ইবেদা বেগম (৭০)। ঘানি থেকে বের হওয়া বিন্দু বিন্দু তেলেই চলে জীবিকা ও সংসার। সালেক উদ্দিনের বাপ-দাদারাও এ পেশাতেই ছিলেন। তাদের আদি নিবাস পূর্ব সুজাইতপুর গ্রামে। নদীর করাল গ্রাসে বাপ-দাদার ভিটের চিহ্ন নেই এখন। তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের নদী রক্ষা বাঁধের ধারে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন। কোনোমতে চলছে তার সংসার। তার বাবা মফিজ সরকারও ঘানিতে তেল ভাঙানোর কাজ করতেন। তার দাদাও এই কাজ করতেন। তখন মহিষ দিয়ে ঘানি টানতেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় এখন একটি গরু কিনতে পারে না। পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে তার। নিজে ঘানি টেনেই তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যথেষ্ট সম্বল না থাকায় ছেলেদেরও কোনো পাথেয় করে দিতে পারেননি। ছেলেরাও এই পেশায় জড়িত থাকলেও তাদের সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। সাধ থাকলেও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের সাধ্য হয় না তাদের। ছেলেরাও গরুর বদলে নিজেই গাছ টেনে আহরিত তেল থেকে সংসার চালায়। বয়সের কারণে সালেক উদ্দিনের ঘানির গাছ টানা অনেক কষ্ট সাধ্য হয়েছে। এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকায় অন্য পেশার কাজ করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই ঘানি টেনে চলছেন।
স্ত্রী ইবেদা বেগম বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে এভাবে স্বামীর সঙ্গে ঘানি টানেন। প্রথমে খারাপ লাগলেও সংসারের রোজগার বাড়াতে বৃদ্ধ স্বামীকে সহযোগিতা করেন তিনি। বাজার থেকে সরিষা কিনে এনে তা কাঠের ঘানিতে দিয়ে তেল প্রস্তুত করতে হয়। পরে তা খাবার উপযোগী করে বাজারে বিক্রি করেন। তবে অসুস্থ হলে রোজগার বন্ধ হয়ে যায় সালেক উদ্দিনের।
নিয়মিত ক্রেতা জামরুল ইসলাম জানান, নদী ভাঙার কারণে অন্য এলাকা থেকে এই এলাকয় এসে বসবাস করছেন। তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। সমাজের বিত্তবানরা যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে তারা খেয়ে পরে বাঁচতে পারবেন।
তেকানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল মন্ডল বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে যতটুকু সাহয্য করা সম্ভব হয় ততটুকু করতে পারি। তবে তাদের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে সরকারিভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন সাহায্য করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে বলেন, 'বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমি অবাক হচ্ছি এখনও এত দরিদ্র মানুষ আছে, যাদের সত্যিই সাহায্য প্রয়োজন। তাদের জন্য যথাযথ সহায়তা করার চেষ্টা করব।'