রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

পাহাড় ও পরিত্যক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন করে লাভবান কৃষক

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
পাহাড় ও পরিত্যক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন করে লাভবান কৃষক

কৃষির আধুনিকীকরণ ও কৃষকের অব্যাহত চেষ্টায় দেশের পাহাড়ি অঞ্চল এবং পরিত্যক্ত জমিতে দিন দিন বাড়ছে ফসল উৎপাদন। ফলে পড়ে থাকা জমি কাজে লাগিয়ে একদিকে কৃষক উপকৃত হচ্ছেন, অন্যদিকে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার পাহাড়ে মিলেছে লটকন চাষে সফলতা। অন্যদিকে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে পরিত্যক্ত জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের বাদাম চাষ করে বাড়তি আয় করছেন চাষিরা। এ ছাড়াও ফরিদপুরের সালথায় ১০০ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা ও বগুড়ার পাথরঘাটায় মুগ ডালের আবাদ করে বাম্পার ফলন পাচ্ছেন তারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি জানান, এক সময়ের জংলি ফল লটকন। পাহাড়ের ঢালু আর বনে-জঙ্গলে জন্ম নেওয়া গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকত এ ফল। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ের বিভিন্ন জনপদে দিন দিন ব্যাপক হারে চাহিদা বাড়ছে টক-মিষ্টি এ ফলটির। সময়ের সঙ্গে পালস্না দিয়ে পাহাড়ি বাজার ছাড়িয়ে সমতলের বিভিন্ন জেলায় লটকনের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।

উচ্চ ফলনশীল এই কৃষিপণ্য গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ডালে থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখা যায়। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ টক-মিষ্টি লটকন ছোট-বড় সবার কাছেই অনেক প্রিয়। পাহাড়ে আম-লিচুর বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও পিছিয়ে আছে লটকন। পার্বত্য খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে স্বল্প-পরিসরে ব্যক্তি উদ্যোগে লটকনের চাষাবাদ হচ্ছে। বাড়ির আঙিনা আর পাহাড়ের ঢালুতে গাছে গাছে ঝুলছে লটকনের সবুজ ও সোনালি রঙের থোকা।

উপজেলার রাঙ্গাপানি এলাকার মালিহা গার্ডেনে পাহাড়ের ঢালে ব্যক্তি উদ্যোগে লটকন চাষ করে সফল হয়েছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও সফল কৃষি উদ্যোক্তা মো. মাঈন উদ্দিন। তার সৃজিত মিশ্র ফলদ বাগানের চারপাশে ২০২০ সালে নরসিংদী থেকে ১৫০টি লটকনের চারা এনে লাগিয়েছিলেন তিনি, যা থেকে গত দুই বছর ধরে ফল সংগ্রহ করছেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে শুরু করে ডালপালায় ঝুলে আছে অসংখ্য লটকন। গত বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণ ফলন এসেছে। স্থানীয় বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন টক-মিষ্টি ফল লটকন প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। স্বল্প পরিশ্রম আর কম পুঁজিতে বেশি লাভের সুযোগ থাকায় লটকন চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই।

পাহাড়ের মাটি ও আবহাওয়া লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী জানিয়ে লটকন চাষি মাঈন উদ্দিন বলেন, প্রথমদিকে শখ করেই মিশ্র ফল বাগানের চারপাশে ১৫০টি লটকনের চারা লাগান। গত বছর থেকে সব ক'টি গাছেই ফলন আসছে। এ বছর অধিক ফলন এসেছে। লটকন চাষে তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন নেই। কম পুঁজি ও পরিচর্যায় ভালো ফলন পাওয়া যায়। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে বেচা-বিক্রি। একেকটি গাছের লটকন তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে তার আশা। ক্ষুদ্র ও বাণিজ্যিক চাষিরা পাহড়ের ঢাল কিংবা অনাবাদি জায়গায় লটকন চাষে এগিয়ে আসতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।

উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ইউনুছ নূর জানান, পার্বত্য এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বাজারের চাহিদাও বেশি। উচ্চ ফলনশীল এই ফসল উৎপাদনে কৃষকদের আরও আগ্রহী করা প্রয়োজন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অ.দা) ওঙ্কার বিশ্বাস জানান, মানিকছড়ি উপজেলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রান্তিক পর্যায়ে ৮ হেক্টর টিলা ভূমিতে লটকট চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। বেশি পরিমাণে গাছপালা ও ছায়া থাকায় পাহাড়ি এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কম পুঁজি ও পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় পরিত্যক্ত জমিতে উচ্চ ফলনশীল বাদাম চাষ শুরু হয়েছে। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ছয় প্রদশর্নীতে প্রায় চার একর জমিতে জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের বাদাম চাষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের ছয়জন কৃষক।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় পরিত্যক্ত জমিতে প্রথমবারের মতো লোরি জাতের চীনা বাদামের চাষ হয়েছে।

আব্দুলপুর ইউনিয়নের চিরিরবন্দর গ্রামের (এসএএও) খাদিমুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে বাদাম গাছের মুঠি ধরে টান দিলেই উঠে আসছে থোকা থোকা সোনালি রঙের বাদাম। এসব পরিত্যক্ত জমির মাটিতে বাদাম বাদে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করে বাদামের সমপরিমাণ লাভ হবে না। অন্য ফসল উৎপাদনের চেয়ে বাদাম উৎপাদনে খরচ কম হওয়ায় পরিত্যক্ত জমিতে বাদামের প্রদশর্নী করা হয়েছে। বাদাম রোপণের পর অন্য ফসলের মতো কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। নেই রাসায়নিক সারেরও তেমন ব্যবহার। বীজ রোপণ আর পরিপক্ক বাদাম উঠানোর পর্যন্ত তেমন কোনো খরচও নেই বললেই চলে। উচ্চ ফলনশীল বাদাম চাষে কৃষকরা লাভবান হবেন।

চিরিরবন্দর গ্রামের কৃষক ওমর ফারুক বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসরে সহযোগিতায় তার পরিত্যক্ত প্রায় এক একর জমিতে উচ্চ ফলনশীল লোরি জাতের চীনা বাদাম চাষ করেন। এ এলাকায় ধান, আলু, টমেটো লিচুর চাষ হয়। এই প্রথম বাদাম চাষ করলেন। ফলন বেশ ভালো হবে বলে তার আশা। তা ছাড়া উৎপাদন খরচ খুব কম। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবার বাদাম চাষ করলেও আশা করছেন লাভবান হবেন।

চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা বলেন, চীনা বাদাম একটি স্বল্পমেয়াদি অর্থকরী ফসল। এটি একটি উৎকৃষ্ট ভোজ্য তেলবীজ। চীনা বাদামের বীজে শতকরা ৪৮ থেকে ৫০ ভাগ তেল এবং শতকরা ২২ থেকে ২৯ ভাগ আমিষ রয়েছে। চিনা বাদামের পুষ্টিগুণ অনেক। হেক্টরপ্রতি চীনা বাদামের গড় ফলন ২-২.২ মেট্রিক টন। যেহেতু কম পরিচর্যা লাগে, তাই চীনা বাদাম চাষ করে কৃষক সহজেই লাভবান হতে পারেন। দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ও উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে চিরিরবন্দর এ চলতি খরিপ-১ মৌসুমে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় তিন একর জমিতে বাদাম চাষ করানো হয়েছে।

সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুরের সালথায় ১০০ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এই প্রথম পাট ও পেঁয়াজের পাশাপাশি এ বছর বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা চাষ করেছেন কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, এ বছর ৪০ হেক্টর (১০০ একর) জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৮ থেকে ১০ মে. টন ভুট্টা ফলন হচ্ছে।

উপজেলার ভুট্টাচাষি বারেক শেখ বলেন, ১০ কাঠা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। এবার নতুন তো তাই কাঠা প্রতি আড়াই থেকে তিন মণ ভুট্টা ফলন হচ্ছে। লুৎফর রহমান নামে আরেক কৃষক বলেন, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। প্রতি কাঠায় ৩ মণ করে ফলন হয়েছে। বাজারে দাম পাচ্ছেন এক হাজার টাকা করে প্রতি মণ। উপজেলার ইকবাল শরীফ নামে আরেক চাষি বলেন, এ বছর পেঁয়াজ ও পাট চাষের পাশি চার বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেন। প্রথম হিসেবে ফলন মোটামুটি হয়েছে। ভুট্টা চাষ লাভজনক। বাজারে ভালো দামে বিক্রি করা যায়, আবার ভুট্টা গুড়া করে গরুকে খাওয়ালে গরু মোটা তাজা হয়।

উপজেলা কৃষি অফিসার সুদর্শন সিকদার বলেন, এ বছর উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করা হয়েছে। অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ভুট্টা চাষ লাভজনক। সারা বছর দাম ভালো পাওয়া যায়। আগামীতে ভুট্টা চাষ আরও বাড়তে পারে।

পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, বরগুনার পাথরঘাটায় চলতি মৌসুমে মুগডালের বাম্পার ফলন হয়েছে। দিগন্ত জোড়া মুগ ডালে ছেঁয়ে আছে মাঠগুলো। অল্প সময়ে কম খরচে অধিক লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে এর চাষ। উপজেলার ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ৩০ হাজার ৭৮০ জন কৃষক মুগডাল চাষ করেছেন। সামনে কালবৈশাখী ঝড়ের কথা চিন্তা করে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে শত কোটি টাকার ডাল সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক কৃষাণীরা।

উপজেলা কৃষি অফিসে তথ্য অনুসারে, পাথরঘাটা উপজেলায় সাত ইউনিয়ন এক পৌরসভাসহ বিভিন্ন জায়গায় ডাল চাষ হয়েছে। এ বছর ডাল চাষ হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে যা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মুগডালের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ২৫০ টন। বর্তমান বাজারে কৃষক প্রতি টন ডাল বিক্রি করছেন ৯০ হাজার টাকা। এ বছর উপজেলায় উৎপাদিত ডালের মূল্য ধরা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকার অধিক।

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মুগডাল চাষি শাজাহান খলিফা বলেন, 'আমরা কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। ডালের ওপরে স্বপ্ন আমাদের। মাঠের তিনের দুই অংশের ডাল সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। এ বছর ডালের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। বাজারেও ডালের ভালো মূল্য পাওয়া যাচ্ছে। খরচের চেয়ে অধিক লাভ হওয়ায় আগামী বছর দ্বিগুণ জমিতে ডাল চাষ করব।'

সিসিডিবির এনগেজ প্রকল্পের স্বপ্ন নারী দলের সাগরিকা রানী বলেন, 'আমি ৯৯ শতাংশ জমিতে ডাল চাষ করেছি। জমি চাষ, বীজ ও সার বাবদ খরচ করেছি ১১ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত আমি ৩৫ হাজার টাকা ডাল বিক্রি করেছি। আরও ২০ হাজার টাকার ডাল বিক্রি করতে পারব।'

পাথরঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত হোসেন বলেন, মুগডাল একটি লাভজনক ফসল। মুগডাল চাষের জমিতে পরবর্তী সময়ে আমন চাষ করার জন্য ইউরিয়া সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় ডাল চাষিদের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ বছর হেক্টর প্রতি প্রায় এক টন ডাল ফলন হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে