রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১
উৎপাদন বন্ধ ৪ জেলার এক লাখ হেক্টর জমির

পদ্মায় নেই পানি, সেচ পাম্প বন্ধ ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির

ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
  ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মার তীরে অবস্থিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের প্রধান ক্যানেলে পানি না থাকায় ফেটে চৌচির হওয়া ফসলি মাঠ -যাযাদি

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত দেশের বৃহৎ গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পাম্প ৩ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। জিকের প্রধান ক্যানেলে পানি না থাকায় ভেড়ামারার ৩নং ব্রিজ সংলগ্ন ক্যানেলে স্থানীয়রা ক্রিকেট খেলার আয়োজন করেছে। প্রতিদিন বিকালে জিকের প্রধান ক্যানেলে পানি না থাকায় ক্রিকেট খেলা চলছে।

এদিকে, জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ থাকায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলার প্রায় এক লাখ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। চাষিরা যেমন দিশেহারা, তেমন এ এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন। জিকে খালে পানি না থাকা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া জেলায় এক লাখেরও অধিক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির অভাবে মানুষ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিলিস্নতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৗড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রতিবছর পানি দেওয়ার কথা। কিন্তু সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে পানি না দেওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে সংকট বলে মনে করেন পানি বিশেজ্ঞরা।

১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে ইনটেক চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে সরবরাহ খালের মাধ্যমে কুষ্টিয়াসহ ৪ জেলার ১৩ উপজেলার জমিতে সরবরাহ করা শুরু হয়। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ৩টি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার কৃষকদের সেচ দেওয়ার এ কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। নব্বইয়ের দশকে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়। বিঘাপ্রতি কৃষকরা মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে তারা পানি পেতেন। জিকে'র মাধ্যমে পানি না পাওয়ায় বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ বাবদ প্রতি বিঘায় খরচ পড়ছে প্রায় ৭ হাজার টাকা। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩৫ গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ধানের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। কতদিন পর থেকে আবার ধানের জমিতে সেচ প্রকল্পের পানি পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জি-কে সেচ প্রকল্পের আওতায় শুরুতে তিনটি প্রধান পাম্প ও ১২টি সাবসিডিয়ারি পাম্পের সাহায্যে খালে পানি দেওয়া হতো। এ বছর ৩১ জানুয়ারিতে পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ ফেব্রম্নয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। তাতে কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গাসহ এই চার উপজেলার কৃষকরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারেনি। কারও কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। তাতেও আশানুরূপ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।

সেচ প্রকল্পের দুটি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে একটি পাম্প দিয়ে প্রকল্পের আওতায় সর্বোচ্চ ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। তবে গত এপ্রিলে ১নং পাম্পটি জাপানের ইবারা করপোরেশনের প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় ঠিক করে সচল করা হলেও পদ্মায় পানি স্বল্পতার কারণে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সেচ প্রকল্পের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পাম্প চালুর জন্য সেচ প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলে কমপক্ষে ১৪ ফুট উচ্চতায় পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পদ্মার পানি কমে যাওয়ায় ইনটেক চ্যানেলে পানির স্তর এখন মাত্র ১১ ফুট। ফলে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে সুপেয় পানির অভাবে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। গৃহস্থলি কাজ ও গবাদিপশু পালনে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ অঞ্চলের অনেক কৃষক মাঠে গভীর নলকূপ বসিয়ে শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ধানের ফসলে সেচ দিলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ধান চাষ হচ্ছে ব্যাহত। ধানের শিস শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছে চিটে।

কুষ্টিয়া-৩ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন বলেন, 'গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পানি সংকট নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলেছি। সেচ প্রকল্পের জন্য ১২শ' কোটি ও জিকে প্রকল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ১২শ' কোটিসহ মোট ২৪শ' কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। শিগগিরই এ প্রকল্প একনেকে পাস হবে বলে আমি আশাবাদী। কুষ্টিয়া জেলায় সুপেয় পানির জন্য ২৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে আর পানির সমস্যা থাকবে না।

ভেড়ামারায় জিকে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, দুটি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট ছিল। তৃতীয় পাম্পটি দিয়ে ৩১ জানুয়ারিতে ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু কারিগরি ত্রম্নটির কারণে ১৯ ফেব্রম্নয়ারি ওই পাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর জাপানের ইবারা করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাম্পটি সচল করা হয়েছে। কিন্তু ইনটেক চ্যানেলে স্বাভাবিক পানির স্তর না থাকায় সেচ কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। সেচের জন্য পদ্মায় পানি বৃদ্ধির অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা সুলতানা জানান, সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিয়ষটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি।

জিকে কৃষক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন বলেন, 'এ বছর আমরা এখনো পানি পাইনি। এই মৌসুমে পানি পাওয়া যাবে না এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এখন শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে ধান রোপণ করছি। এভাবে এক বিঘা জমি চাষ করতে প্রায় ৭ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়বে।'

কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। সেচ খালে পানি না থাকায় নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। ক্ষেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুইবারও সেচ দিতে হয়। পানি সরবরাহ শুরু ১৯ দিনের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েন কৃষকরা।

কুষ্টিয়ার পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, চার জেলার ১৩টি উপজেলায় জিকের সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রকল্পের প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল রয়েছে। পানি সমস্যা সমাধানে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। এ সমস্যা হয়তো বেশিদিন থাকবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে