ঢাকঢোল পিটিয়ে রক্ষার মধ্যেও বর্জ্যের ভাগাড় ও দূষণরাজ্য

বুড়িগঙ্গার কুচকুচে কালো পানি যেন রীতিমতো বিষাক্ত

প্রকাশ | ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
বর্জ্যের ভাগাড় ও দূষণরাজ্যে পরিণত হওয়া বুড়িগঙ্গা নদী -যাযাদি
ঢাকার জীবনখ্যাত বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের কারণে এখন প্রায় 'মৃত'। নদী রক্ষার নানা আয়োজনের ঢাকঢোল পেটানোর মধ্যেও বুড়িগঙ্গা আবার বর্জ্যের ভাগাড় ও দূষণরাজ্যে পরিণত হয়েছে। নদীর দুই পাড় ঘেঁষে এখন শুধু আবর্জনার স্তূপ। কালো কুচকুচে পানি যেন বিষ। শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য, সবকিছুর শেষ ঠিকানা নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বুড়িগঙ্গা। এভাবে নদীপাড়ে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় চারদিকের পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সদিচ্ছা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের অনীহার কারণে কিছুতেই প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না বুড়িগঙ্গা। সেই সঙ্গে দুই পাড়ের মানুষ রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এক ভয়াবহ চিত্র। যা নদীর বর্তমান অবস্থায় কোনো জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। কারখানা ও পয়ঃবর্জ্য নির্বিচারে পড়ছে নদীতে। অবহেলা আর দূষণে বুড়িগঙ্গার পানি এখন রীতিমতো বিষাক্ত। কালো জলে দুর্গন্ধ নিয়েই বয়ে চলেছে। পানির এমন রংই বলে দেয় কতটা দূষণের শিকার বুড়িগঙ্গা। গবেষণা ছাড়া খালি চোখেই বলা দেওয়া যায়, এই নদীতে বাঁচতে পারে না কোনো প্রাণ। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখন প্রায় অক্সিজেনশূন্য। নদীর প্রতি লিটার পানিতে এখন অক্সিজেনের মাত্রা শূন্য দশমিক এক ছয়, যার স্বাভাবিক মাত্রা চার। জিনজিরা ইউপি চেয়ারম্যান সাকুর হোসেন বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীতে আসলে পানি নেই। এটা হলো বিষ। এখানে জলজ কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না। এখানে যদি কেউ কখনো পড়েও যায়, তার আর বাঁচা সম্ভব না। মুহূর্তেই মরে যাবে। নিয়মিত নদী পারাপার হতে হয় যাদের, ভালো নেই তারাও। ভুগছেন নানা শারীরিক সমস্যায়। এ সময় যুবক সাব্বির হোসেন বলেন, 'আমাদের বাসায় প্রতিদিনই গন্ধ আসে। এখন শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়ে গেছে।' বেসরকারি সংস্থা পরীজার সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান বলেন, যারা দায়িত্বে আছেন, সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়, আমি মনে করি, তাদের এখানে প্রচুর দুর্বলতা আছে। তারা বিষয়টিকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি সে উদ্যোগ। আদালতের নির্দেশ অমান্য করেই কারখানা আর পয়বর্জ্যে ডুবছে বুড়িগঙ্গা।' সরেজমিন নদীর পানি দেখে মনে হতে পারে, কালো কোনো ক্যানভাস রঙিন হয়েছে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায়। বাস্তবতা হচ্ছে, এটি পানিতে ভাসমান পস্নাস্টিকের সূক্ষ্ণ কণা। রাজধানীর পাশে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার কালো রঙের পানি বলছে নদীর জীবনের অবস্থা। নগরীর বর্জ্য ও সুয়ারেজ ও ড্রেনেজ লাইন সঙ্গে পলিথিন। সব মিলিয়ে এই নদীর নীল পানি পরিণত হয়েছে নিকষ কালোতে। আর পানির স্তরে স্তরে মেলে নানা ধরনের পলিথিন। ৪০০ বছর আগে যে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা, সেই ঢাকার বর্জ্য এখন ঘিরে ফেলেছে নদীকে। ঢাকা মহানগর, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যের একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রতিটি ফোঁটা এই নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখতে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও ডায়িং কারখানা, সিটি করপোরেশনের ময়লা, সদরঘাট বন্দর- এই তিনটি উৎসই বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণ বর্তমানে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে পানির পিএইচ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬, ৬ দশমিক ৭ ও ৮ দশমিক ৫। এ ক্ষেত্রে ৭-কে মানদন্ড ধরা হয়। সমীক্ষায় জানা গেছে, পানিতে মোট ভাসমান অদ্রাব্য পদার্থের (সাসপেন্ডেড সলিড) পরিমাণ ছিল সাধারণ মানদন্ড ১০-এর বিপরীতে প্রতি লিটারে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। প্রতি লিটারে রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) ছিল ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬ মিলিগ্রাম, যার মানদন্ড ৪। সাধারণ মানদন্ড শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রামের বিপরীতে জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা (বিওডি) ছিল প্রতি লিটারে ৮৭, ৭২ ও ১০৬ মিলিগ্রাম, যা পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন অনেক পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পোস্তগোলা সেতুর দুইপাড়, কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা, আগানগর থেকে পাগলার মেরি অ্যান্ডারসন পয়েন্ট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা তীরের পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে কয়েক ডজন ডায়িং কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গায় দূষণ ছড়িয়ে যাওয়া কেরানীগঞ্জের ওয়াশিং পস্ন্যান্টগুলো হচ্ছে- ঝর্ণা ওয়াশিং, এসবি ওয়াশিং, গেস্নাবাল ওয়াশিং, সায়মা ওয়াশিং, হজরত ওয়াশিং, আহামদ হোসেন ওয়াশিং, আমেনা ওয়াশিং, সানমুন ওয়াশিং, ইডেন ওয়াশিং, বিসমিলস্নাহ ওয়াশিং, লোটাস ওয়াশিং, রুবেল ওয়াশিং, আনুস্কা ওয়াশিং, সততা ওয়াশিং, চঞ্জল ওয়াশিং, আব্দুর রব ওয়াশিং, ঢাকা ওয়াশিং, আজান ওয়াশিং, নিউ সাহারা ওয়াশিং, দোহার ওয়াশিং, রিলেটিভ ওয়াশিং, নিউনাশা ওয়াশিং, ইউনিক ওয়াশিং, মৌ ওয়াশিং, সেতু ওয়াশিং, কোয়ালিটি ওয়াশিং, জুয়েনা ওয়াশিং, কামাল ওয়াশিং, ওয়াটার কালার ওয়াশিং, পারজোয়ার ওয়াশিং, জিএম ওয়াশিং, কুমিলস্না ওয়াশিং, আছিয়া ওয়াশিং ও লিলি ওয়াশিং। ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে ছোটবড় দুই শতাধিক ট্যানারি স্থানান্তর করা হলেও ওয়াশিং কারখানাগুলো এখন বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত রাখার সবচেয়ে বড় বাধা। হাইকোর্টের একটি আদেশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) ২০২১ সালের শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার অন্তত ৫০টি কারখানার পানি, বিদু্যৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যাতে তারা বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করতে বাধ্য হয়। তবে হাইকোর্ট কারখানাগুলোকে ইটিপি স্থাপনের পর পরিষেবার সংযোগ পুনঃস্থাপন করার জন্য ডিওই নির্দেশনা থাকলেও এখন পর্যন্ত তার কিছু হয়নি। কালো-নীল পানিতে সাকার মাছের লাফালাফি দেখতে দেখতে কথা হয় বুড়িগঙ্গার বুকে জীবনের চলিস্নশটি বছর কাটানো মাঝি ইদু মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, এখন আর তেমন মাছের দেখা মেলে না। যাও বা পাওয়া যায়, তা (সাকার) খাবারের অযোগ্য। জেলে দম্পতি মনোয়ার আর পারুল বেগম জানান, তাদের জালে তিন-চার কেজির মতো মাছ উঠেছে। তবে এর মধ্যে সাকার মাছই সব। অন্য মাছ পাওয়া গেছে হাতেগোনা কয়েকটা। ছড়িয়ে পরা এই মাছের সংখ্যা কীভাবে কমানো যাবে তার কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারে। তারা আরও জানান, নদীর পানিতে এখন যারা গোসল করেন, তাদের অনেকেই স্কার্ভিসহ নানা চর্ম রোগে আক্রান্ত হন। অনেক সময় আমাদের চোখে জ্বালা-পোড়া ও চুলকানিও হয়। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. জামিল ফয়সাল বলেন, 'বুড়িগঙ্গার দূষণের ভয়াবহতা আমরা সবাই জানি। দূষণের ফলে দুই পাড়ের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। যেমন : শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চর্ম রোগসহ বায়ু ও পানিবাহিত রোগের মাত্রা বেড়েছে। ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে এখনই নদীদূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সরকারের। বিশেষ করে কারখানাগুলোর বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধিত করে যেন নদীতে ফেলা হয়। সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারে বিভিন্ন সংস্থাকে আরও বেশি কড়াকড়ি হতে হবে। তাহলে নদীও দূষণ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে।' উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, 'কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে নিয়মিত। আমরা নানা সময় বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। আসলে তারা কেউই কার্যকারী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে কারও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের শরিফ জামিল বলেন, একসময়ের দূষণমুক্ত ও খরস্রোতা বুড়িগঙ্গা কল-কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের কারণে প্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এখানে কোনো মাছ কিংবা জলজ জীবের অস্তিত্ব থাকে না। আমরা একে জৈবিকভাবে মৃত অবস্থা বলি। এদিকে শিল্পবর্জ্যসহ নানান দূষণে বিপর্যস্ত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পৌঁছে যাচ্ছে ইলিশের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র পদ্মা-মেঘনায়। দূষণের কারণে নদীতে মাছ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। পদ্মা-মেঘনাকে দূষণমুক্ত রাখতে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ না করা গেলে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ উৎপাদন আরও কমতে থাকবে।