আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী 'অল্প পুঁজি, অল্প আয়' কৌশলে, সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে মুরগির উৎপাদনচক্রে (একবার ডিম পাড়া থেকে পুনরায় ডিম পাড়ার আগ পর্যন্ত) সময় বেশি লাগা, কম ডিম পাড়া, ডিম না ফোঁটা, বাচ্চা মৃতু্য হার বেশি হওয়ায় দেশি মুরগি পালন অতটা লাভজনক হয়ে ওঠেনি।
একটি উৎপাদনচক্র শেষ করতে দেশি মুরগি ১৪০-১৬৫ দিন সময় নেয়। এ সময়ে একটি মা-মুরগি ১৫-১৮টি ডিম এবং বছরে ৪৫-৫০টি ডিম পাড়ে। এ সময় পুষ্টির ঘাটতি এবং ডিমে তা (ওম) দেওয়ার সময় পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় এর মধ্যে বড়জোড় ৩৫-৪০টি বাচ্চা ফোঁটে। এছাড়া প্রাকৃতিক শিকারি (চিল, কাক, বেজি, বনবিড়াল ইত্যাদি) দ্বারা এবং রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্য হওয়ায় এর মধ্যে মাত্র ১০-১২টি বাচ্চা ডিম বা মাংস দেওয়ার উপযোগী বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার জন্য অনেকক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে থাকে।
এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এবং দেশি মুরগি পালন লাভজনক করতে বিশেষ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতে দারিদ্র বিমোচন সংস্থা মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলায় পিকেএসএফের সহযোগিতায় গত ১ বছরে মোট ১২০ জন খামারিকে আটটি ক্লাস্টারে প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করেছে। প্রতিটি খামারে বড় মুরগি রাখার জন্য রাত্রিকালীন ঘর, বাচ্চা মুরগির জন্য ক্রিপারসহ খাঁচা, ডিম ফুটানোর নেস্ট, বৈদু্যতিক বাল্ব, স্প্রে জীবাণুনাশক, সাইনবোর্ড ও তথ্য বই সরবরাহ করেছে গ্রামীণ গৃহিণীদের। সংস্থাটি সঠিকভাবে সব ধরনের কারিগরি সহযোগিতা, জীব-নিরাপত্তা, ব্রম্নডিং ব্যবস্থাপনা, খাবার ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত টিকা প্রদান করায় দেশি মুরগির উৎপাদন ওই এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এই পদ্ধতিতে মুরগি পালন করায় ডিম ও মুরগি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন খামারিরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এই পদ্ধতিতে মা মুরগির রাত্রিকালীন থাকার ঘর, ডিম পাড়া ও ডিমে তা দেওয়ার নেস্ট এবং বাচ্চার মৃতু্য হার কমানোর জন্য বিশেষ ডিজাইনের ক্রিপারসহ খাঁচার ব্যবস্থা করা হয়। মা-মুরগির ডিমে তা দেওয়ার সময় নেস্টের সামনে পর্যাপ্ত খাবার ও পানির ব্যবস্থা, যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে মা মুরগি ডিমে তা দিতে পারে এবং ডিম ফোঁটার হার বৃদ্ধি পায়। বাচ্চা ফোঁটার পর মাসহ বাচ্চাগুলোকে তিন প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট ক্রিপারসহ খাঁচায় ২ মাস লালনপালন করতে হয়। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে একটি খাবার ও পানির পাত্র থাকে এবং সেখানে একটি মা মুরগি তার ১০-১২টি বাচ্চাসহ থাকতে পারে। এতে প্রাকৃতিক শিকারি দ্বারা বাচ্চার মৃতু্য হার রোধ হয়। খাঁচায় থাকায় বাচ্চাগুলো নিবিড় পরিচর্যায় থাকে। সময়মতো দুইটি রাণীক্ষেত, দুইটি গামবোরো রোগের টিকা ও একটি ফাউল কলেরা রোগের টিকা নিশ্চিত করলে রোগবালাইজনিত মৃতু্য হার রোধ করা সম্ভব। ফলে ৯০-১০০% বাচ্চা ডিম বা মাংস দেওয়ার উপযোগী সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
এ ছাড়া ক্রিপারসহ খাঁচায় ছয়-সাত দিন বাচ্চার সঙ্গে অবস্থান করানোর পর মা মুরগিকে আলাদা করে দেওয়া হয়, যাকে উইনিং বলে। ফলে মা মুরগি দ্রম্নত বাচ্চার মায়া ত্যাগ করে এবং অল্প সময়ে আবার ডিম দেয়। এতে করে একটি মা মুরগি বছরে ৯০-১২০টি ডিম উৎপাদন করতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা ডিবিএসর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুহুল আমিন সরদার জানান, বর্তমানে দেশি মুরগির তুলনামূলক স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প জায়গায় লালন-পালন করা সম্ভব। বর্তমান বাজারে দেশি মুরগির দাম অনেক বেশি হওয়ায় খামারিরা অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ করতে পারেন। পিকেএসএফের অর্থায়নে স্থানীয় দারিদ্র বিমোচন সংস্থার সহযোগিতায় মেহেরপুর সদর উপজেলায় আটটি ক্লাস্টারে ১২০টিরও বেশি বিশেষ আবাসন নিশ্চিত করে আধা-বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন খামার গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে এই দেশি মুরগি পালন করে অনেকেই স্বাবলম্বি হয়েছেন।
সংস্থাটির সহকারী পরিচালক জুবায়ের আলম জানান, ডিবিএস সবসময় প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি এর গুণাগতমান বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই গুণাগতমান ও উৎপাদনশীলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।