পঞ্চগড়সহ উত্তরের সমতলের চা দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হলেও উৎপাদনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় চা অঞ্চল। গত বছর এ অঞ্চলে রেকর্ড এক কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড দাবদাহ আর অনাবৃষ্টিতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমতলের এই চা অঞ্চল। বিবর্ণ হয়ে পড়েছে সবুজ চা গাছ। প্রচন্ড রোদে চা গাছ ঝলসে যাচ্ছে। কুকড়ে যাচ্ছে গাছের কচি কুঁড়ি। খরার কারণে চা গাছে লাল মাকড়সা, লুপারসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। ক্রমাগত লোকসানের শংকায় চা বাগানে সেচসহ নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করছেন না বাগান মালিকরা। আর যারা ঝুঁকি নিয়ে সেচ দিচ্ছেন তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। সেচ দেওয়ার পরদিনই আগের অবস্থাতেই ফিরে যাচ্ছে চা বাগান। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চা কারখানাগুলোতে। কাঁচা চা পাতা সরবরাহ কমে যাওয়ায় জেলার অর্ধেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে সমতলের চা অঞ্চলে চা উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।
শুক্রবার সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর থেকে কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে চা চাষিরা। অনেকে আবার চা চাষ তুলে ফেলে অন্য ফসল আবাদ করেছেন। প্রয়োজনীয় সেচ ও সময়মত কীটনাশক প্রয়োগের অভাবে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে চা বাগান। এরই মধ্যে প্রচন্ড দাবদাহে ঝলসে যাচ্ছে বাগানের চা গাছ। পর্যাপ্ত পানির অভাবে চায়ের কচি পাতা কুঁড়ি কুকড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত খরচে সেচ দেওয়ার পরও ঝিমিয়ে পড়ছে বাগানের চা গাছ। ফলে চা পাতা উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন চা বাগানে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা গোফাপাড়া গ্রামের চা চাষি মজিবর রহমান জানান, 'মার্চের শুরুতে প্রথম রাউন্ডে কিছু চা পাতা কারখানায় দিয়েছি। এপ্রিলের শুরু থেকে ২য় রাউন্ডের চা উত্তোলনের কথা। কিন্তু টানা খড়ার কারণে বাগানে পাতা নেই। নতুন পাতা গজানোর আগেই কচি চা পাতা কুকড়ে যাচ্ছে। কীটনাশক পানি দিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।'
একই কথা জানালেন একই উপজেলার চানপাড়া গ্রামের চা চাষি কবির হোসেন। তিনি জানান, 'পানি সেচ দিয়ে আমরা কুলাতে পারছি না। অনাবৃষ্টির কারণে দাবদাহ বেড়েছে। খড়ায় চা বাগান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চা পাতার দাম অনুযায়ী অতিরিক্ত খরচ করে কীটনাশক আর সেচ দিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছি। শুধু আমাদের খরচ বাড়ছে, চা পাতার দাম বাড়ছে না।'
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ আমির হোসেন বলেন, 'টানা এক মাসের দাবদাহের কারণে বাগানে চা উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। প্রচন্ড রোদ, তীব্র গরম এবং দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চা বাগানে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গেছে। পাতার অভাবে ২৮টি চালু কারখানার মধ্যে প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা চা চাষিদের অতিরিক্ত সেচসহ কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছি। আকাশে বৃষ্টি হলে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।'
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতলে ২০০০ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চা চাষে বিপস্নব ঘটে উত্তরের এই জেলায়। সেই সঙ্গে আশপাশের কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে সম্ভাবনাময় দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল। বর্তমানে উৎপাদনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল এই সমতলের চা। পঞ্চগড়সহ উত্তরের পাঁচ জেলায় ৯টি নিবন্ধিত চা বাগান, ২০টি অনিবন্ধিত চা বাগান এবং ৮ হাজার ৩৭১টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানসহ মোট ১২ হাজার ১৩২ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০২৩ সালের চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী এই অঞ্চল থেকে ৮ কোটি ৬১ লাখ, ৪৬ হাজার ৭০৪ কেজি সবুজ পাতা থেকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার ২৮টি চলমান চা কারখানায় এক কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। জাতীয় চা উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের অবদান ১৭.৪৪%, যা অঞ্চলভিত্তিক চা উৎপাদনে দ্বিতীয়। উত্তরাঞ্চলে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত চা কারখানার সংখ্যা ৫৮টি। দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চগড়ে।