মরে যাচ্ছে মুরগি ফেটে চৌচির ক্ষেত
রাজবাড়ীতে তীব্র দাবদাহে পানির নিদারুণ কষ্ট
প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
মতিউর রহমান, রাজবাড়ী
রাজবাড়ীর তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। নিকট অতীতে এমন দাবদাহ দেখেনি জেলাবাসী। তীব্র দাবদাহে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে চরম পানি সংকট। জেলার বেশিরভাগ নলকূপেই পানি উঠছে না। ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সেচ দিতে পারছে না কৃষক। বিরূপ প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। প্রচন্ড গরমে পোল্ট্রি খামার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে মুরগি। লোকসান দিয়ে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন মুরগি। নলকূপে পানি না ওঠায় মানুষের দুর্দশাও উঠেছে চরমে। জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র। গরম থেকে রক্ষা পেতে জেলা প্রশাসন ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাচরাণা চালানো হচ্ছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামে জিহাদ পোল্ট্রি ফার্মে গিয়ে দেখা যায়, শেডটিতে অল্পসংখ্যক কিছু ব্রয়লার মুরগি গরমে হাঁসফাঁস করছে। ওপরে কয়েকটি বৈদু্যতিক পাখা ঘুরছে তাদের ঠান্ডা রাখার জন্য। শেডের ওপরে টিনের চালে স্থাপন করা হয়েছে পাঁচটি মোটর। যেগুলো দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। যাতে শেডটিকে শীতল রাখা যায়। এ সময় কথা হয় ফার্মের মালিক জিহাদ হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, খুবই বিপাকে আছেন মুরগিগুলো নিয়ে। ছয় বছর আগে সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ফার্মটি দিয়েছিলেন। লাভ ভালোই হতো। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় যতটা বিপাকে পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন তীব্র গরমে। অস্বাভাবিক গরমে মুরগিগুলো কিছু খাচ্ছে না। মুরগিগুলো টিকিয়ে রাখতে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তারপরও প্রতিদিন সাত থেকে আটটি মুরগি মারা যাচ্ছে। যেভাবে ফ্যান ও মোটর চলছে তাতে মাসে ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল আসবে। এটা পোষানো খুবই কঠিন হয়ে যাবে। তার এ পর্যন্ত দেড়শ মুরগি মারা গেছে।
একই ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামের শওকত আলী জানান, গরমের শুরুর দিকে একদিনে চার ঘণ্টার মধ্যে ২৪টি মুরগি মারা যায়। আরও ২২টি মুরগি জবাই করতে হয়েছে। তার খামারে ৮শ' মুরগি ছিল। এ অবস্থায় বাকি মুরগি রাখা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে সেগুলো বিক্রি করে দেন। সদর উপজেলার দাদশী ইউনয়নের লক্ষ্ণীকোল গ্রামের খোকন মিয়া তার খামারে এক হাজার ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তুলেছিলেন। ৩১ দিন পর ওজন হওয়ার কথা ছিল দুই কেজি করে। সেগুলোর ওজন হয়েছে এক কেজি তিনশ' গ্রাম করে। সাত দিনে মারা গেছে ১২০টি মুরগি। এ অবস্থায় খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।
রাজবাড়ী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রচন্ড দাবদাহ চলছে। খামার ঠান্ডা রাখার জন্য তাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বেশি অসুস্থ হলে স্যালাইন খাওয়ানোর কথা বলছেন। যদি কারও মুরগি মারা যায় তাহলে তাদের জানালে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাদের মাঠকর্মীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে পরিদর্শন করে পরামর্শ দিচ্ছেন।
এদিকে তীব্র দাবদাহে চাষাবাদে প্রচন্ড সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষক। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় জমিতে সেচ দিতে পারছেন না। ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফলে মারা যাচ্ছে পাট। জেলার পাঁচ উপজেলায় বিরাজ করছে এ অবস্থা। অনেক কৃষক স্যালোমেশিনে পানি তুলতে ১২ ফুট গর্ত করেছেন। সেখানে শ্যালোমেশিন বসিয়ে পানি তুলে সেচ দিচ্ছেন। সদর উপজেলার বানিবহ ইউনিয়নের বানিবহ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানে কোনো নলকূপে পানি উঠছে না। অনেকে নলকূপের সঙ্গে মোটর বসিয়েছেন। তারপরও পানি উঠছে না।
পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের আন্দুলিয়া গ্রামের কৃষক ময়েন উদ্দিন জানান, পানির সংকট বাড়ি ও মাঠে দুই জাগাতেই। বাড়িতে নলকূপে আর মাঠে শ্যালো মেশিনে পানি নেই। মাঠে ১২ ফুট গর্ত করে সেখানে শ্যালো বসিয়ে দুইবার পাট ক্ষেতে সেচ দিয়েছেন। এখন জমি ফেটে চৌচির। কিন্তু শ্যালোতে পানি উঠছে না। শিগগির বৃষ্টিপাত না হলে পাট সব শেষ হয়ে যাবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রচন্ড দাবদাহে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চরের বাদাম গাছগুলো পুড়ে যাচ্ছে। বোরো ধানে চিটা হতে পারে। পাটের চারা যেগুলো গজাচ্ছে এগুলো বড় না হতেও পারে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সেচ দিতে হবে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিএডিসির সঙ্গে কথা বলেছেন। সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বেলগাছী গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সেখানের বাসিন্দারা পানির জন্য কী নিদারুণ কষ্টে আছেন। গড়ে ২০টি পরিবারের মধ্যে একটি বড় জোর দুটি নলকূপে পানি উঠছে। দূর-দূরান্ত থেকে পানি এনে তারা দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন।
গৃহবধূ মিতা সাহা জানান, তাদের বাড়িতে চারটি পরিবারে সদস্য সংখ্যা ১৬ জন। তিনটি নলকূপ ও দুটি মোটর রয়েছে। কিন্তু কোনোটিতেই পানি উঠছে না। আশপাশে একটি বাড়িতেই পানি ওঠে। সেখানে দিনে দু-একবার গিয়ে খাবার পানি এনে মজুত করে রাখেন। গরমে বেশিক্ষণ রাখা যায় না। কিন্তু উপায় নেই। আর গোসল জামা কাপড় ধোয়ার জন্য এক কিলোমিটার দূরে একটি পুকুর আছে। সেখানে যান। গত চার বছর ধরে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে এ সমস্যা হয়। দুই মাসের মতো তাদের পানির কষ্ট ভোগ করতে হয়। একই গ্রামের নিতাই সাহার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার নলকূপেও পানি উঠছে না। ওই বাড়ি থেকে একশ ফুট দূরে তার ভাগ্নের বাড়ি থেকে পাইপ দিয়ে পানি এনে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। তার ভাগ্নে রমেন সাহা জানান, তিনি মোটর বসানোর সময় ১২ ফুট গর্ত করে হাউজ বসিয়ে তার নিচে পাইপ দিয়েছেন। যে কারণে পানি উঠছে। এই গ্রামে একটি বরফ কলে গিয়ে জানা যায়, বরফকলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি নেওয়ার জন্য লাইন থাকে মানুষের। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার সময়ও দেখা গেছে কয়েকজনকে পানি নিতে।
কালুখালী উপজেলার দামুকদিয়া গ্রামের ফুলবানু বেগম বলেন, 'এখন শুকনোর সময় আমরা ধান সিদ্ধ করে রাখি। কিন্তু পানির অভাবে তা পারছি না। গরুর গোসল করাতে পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় মরুভূমিতে বাস করছি।'
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ, চন্দনী, মিজানপুর, দাদশী, আলীপুর, মূলঘর, কালুখালী উপজেলার মদাপুর, পাংশা উপজেলার সরিষা, বাবুপাড়া, কলিমহর, মৌরাট, পাট্টা ইউনিয়নেও চলছে পানির সংকট। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারিভাবে তারা সদর উপজেলায় ৫ হাজার ৯৭১টি নলকূপ স্থান করেছে। যার মধ্যে অকেজো ৪২০টি। এ ছাড়া গোয়ালন্দে ২ হাজার ৬৪৮টির মধ্যে ২৩১টি, পাংশায় ৪ হাজার ৪৮১টির মধ্যে ৪১০টি, বালিয়াকান্দিতে ৩ হাজার ৬৪৬টির মধ্যে ২৪৮টি তএবং কালুখালীতে ২ হাজার ৪৯০টির মধ্যে ৪৩২টি নলকূপ অকেজো রয়েছে।
রাজবাড়ী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাকারিয়া বলেন, 'পানির স্তর ২৫ ফিটের নিচে নেমে গেলে হাতে তোলো নলকূপে আর পানি ওঠে না। রাজবাড়ীর সদর, পাংশা, বালিয়াকান্দি, কালুখালী এই চার উপজেলায় গ্রীষ্মে পানির স্তর ২৫ ফিটের নিচে নেমে যায়। এজন্য আমরা হাতে তোলা নলকূপ এখন বরাদ্দও দেই না। বড় ধরনের বৃষ্টি হলে এ সমস্যা কেটে যাবে।'