চলতি মৌসুমে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় ভুট্টার ফলন ভালো হয়েছে। দামও আশানুরূপ পাচ্ছেন চাষিরা। তাই তাদের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় চাষিরাও খুশি রয়েছেন। ভুট্টা কেনাবেচায় হাট-বাজারগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে। বিপণন করতে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক দিনরাত কাজ করছেন। নারীরা দক্ষ হয়ে ওঠায় এ কাজে তাদের কদর বাড়ছে।
উপজেলার যমুনা ও বাঙালি নদীর চরে অনেক জমি বছরের পর বছর পতিত থাকে। এসব জমিতে তেমন কোনো ফসল চাষ করা যায় না। এসব পতিত জমিতে এখন কৃষকরা শ্যালোমেশিনের সাহায্যে নানা জাতের ফসল ফলাচ্ছেন।
ফসলগুলোর মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে ভুট্টা। এ ফসলে অন্য ফসলের তুলনায় কম পানি সেচ দিতে হয়, বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ভুট্টার ফলন ভালো হয়, অন্য ফলনের তুলনায় এর পরিচর্যাও কম, ফলে এ বছর কৃষকরা ভুট্টার ফলন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছেন।
উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এখন কৃষকরা ভুট্টার গাছ থেকে মোচা সংগ্রহ, মোচা থেকে ভুট্টার দানা ছাড়ানো, কাঁচা ভুট্টা পরিবহণে ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে আসা, সেগুলো আবার উঠানে শুকানো এবং সর্বশেষ উৎপাদিত ভুট্টা বাজারজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ বছর কৃষকরা বস, ৯০০ এম গোল্ড, সুপার-২৭৬০, এন কে-৪০, মীরাকেল, কাবেরি, নবাব, উত্তরণ, গড ফাদার এবং বিএডিসি প্রভৃতি হাইব্রিড জাতের ভুট্টার চাষ করেছেন।
উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের কুড়িপাড়া চরের কৃষক আব্দুল হামিদ সরদার জানান, গত ২ বছর থেকেই তিনি ভুট্টার আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। এ বছর তার ৪৫ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেন। এর মধ্যেই ৩৫ বিঘার বেশি জমির ভুট্টা কেটেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে তার গড় ফলন হয়েছে ৪০ মণ। বাজারে প্রতিমণ ভুট্টা ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।
তার সব জমিতে সর্বমোট ৮ লাখ টাকার কাছাকাছি খরচ হয়েছে। তিনি আশা করছেন সব জমির ভুট্টা তার ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হবে। গত বছর তার প্রতি বিঘা জমিতে ফলন হয়েছিল ৫০ মণ এবং দাম পেয়েছেন ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এ বছর তুলনামূলক দাম কম পেলেও তার বেশ ভালোই লাভ হবে।
সারিয়াকান্দি কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী গত বছর এ উপজেলায় ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর, অর্জন হয়েছিল ৬ হাজার ৪৪০ হেক্টর। এ বছর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার হেক্টর, যা লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে ৮ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমির ভুট্টা কর্তন করা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, প্রতি বছরের তুলনায় এ বছর সারিয়াকান্দিতে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। চরাঞ্চলের কৃষকরা এখন চরের বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ভুট্টার আবাদ করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এ ফসল চাষে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সোনাতলা (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কৃষকরা স্বপ্নের বীজ বুনছেন যমুনার চরে। মরিচ, ভুট্টা, পাট, বাদাম, মসুর ডাল, খেসারি, কাউন, খেরাচিসহ নানা ধরনের বীজেই তাদের বর্তমান ও আগামীর স্বপ্ন। পাখির কোলাহল ও ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনিতেই ঘুম ভাঙে ওখানকার মানুষের। প্রতিদিনের পরিশ্রম ছাড়া অন্ন জোগান দেওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
এ চরে প্রায় ১১টি গ্রামে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। খাদ্যশস্য উৎপাদন করাই যাদের বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে জীবিকা নির্বাহের মূল অবলম্বন। ওখানে উলেস্নখযোগ্য ফসলগুলোর মধ্যে ভুট্টা অন্যতম। এই ফসলকে চরের স্বর্ণও বলা হয়ে থাকে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। এরমধ্যে চরাঞ্চলেই চাষ হয়েছে ৩০০ হেক্টর।
সরেজমিন গিয়ে উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের পূর্ব তেকানীসহ চরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষ সব থেকে লাভজনক। অর্থাৎ অন্য ফসলগুলোতে নানা ধরনের রোগবালাই ও ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত নানা ধরনের ভয় থাকলেও ভুট্টা চাষ একেবারেই শঙ্কামুক্ত। কারণ এ সময়ে নেই বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অন্যদিকে ভু্ট্টা চাষের জন্য শীতকাল বেশ উপযোগী। কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, আমি গত বছর সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করি। তাতে ১২০ মণের বেশি ফলন হয়েছে। গত বছরে ৮শ' থেকে ১১শ' টাকা পর্যন্ত বাজারদর পেয়েছি। এ বছর আবারও ভুট্টা চাষ করেছি। অন্যান্য ফসলের চেয়ে ভুট্টা চাষে পরিশ্রম কম এবং বাজারদর ভালো পাওয়া যায়।
একই গ্রামের তারেক বলেন, গত বছর ৩ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করলেও এবার ৭ বিঘায় করেছি। রানীরপাড়া গ্রামের জিলস্নুর রহমান বলেন, আমি গত বছর ১০ কাঠা জমিতে ভুট্টা চাষে ২০ মণ ফলন পাই। এ বছর ১ একর জমিতে ভুট্টা করেছি। পাকুল্যা ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কৃষক আনারুল বলেন, আমি গত বছর ১০ শতাংশ জমিতে ভুট্টা চাষ করে ভালো ফলন ও বাজারদর পাওয়ায় এ বছর সাড়ে ৩ বিঘা আবাদ করেছি। প্রতি বিঘায় প্রায় ৫৩ মণ ভুট্টা পেয়েছি। ভুট্টা চাষই আমার কাছে সব থেকে নিরাপদ ফসল মনে হয়।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু জমিতে মাষকালাই চাষ করলেও বেশির ভাগ জমি প্রস্তুত করে নেওয়া হয় ভুট্টা ও মরিচ চাষের জন্য। ভুট্টা বীজ বপন থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রায় ১০০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। এর মধ্যে আগাম ও উফশী ভুট্টা চাষে কৃষকের আগ্রহ বেশি। ফলন কম হওয়ায় দেশীয় জাতের ভুট্টা চাষ বর্তমানে নেই বললেই চলে। চরে এবার বাদশা-৫৫৫, থ্রি গোল্ড, বর্ণালি, মোহরসহ বিভিন্ন জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়েছে। হাইব্রিড ভুট্টা চাষে ফলন বেশি পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষে প্রায় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। ভালো ফলন হলে জমির প্রকার ভেদে বিঘা প্রতি ৩৫ থেকে ৫০ মণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ হাজার টাকা মণ হলেও প্রতি বিঘা থেকে অন্তত ৩০ হাজার টাকা ঘরে তুলতে পারেন কৃষকরা।
এ বিষয়ে সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, ভুট্টা একটি লাভজনক ফসল। সোনাতলা উপজেলায় এ বছর ৪৫০ হেক্টর ভুট্টা চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৭৫ হেক্টর বেশি। ভুট্টার বাজারদরও এখন বেশি। ভবিষ্যতে ভুট্টা চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।