প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাব, অবকাঠামোগত অসুবিধাসহ ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীর স্বল্পতা- সেই সঙ্গে সময় মতো চিকিৎসকদের হাসপাতালে না আসায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী হাসপাতালে গুণগত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার রোগীরা। সামান্য সমস্যা হলেই চিকিৎসা না দিয়ে অধিকাংশ রোগীকে পাঠানো হয় গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর এবং ঢাকার হাসপাতালে। ভোগান্তির শেষ কোথায় কেউ জানে না!
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কাশিয়ানী উপজেলা সদরে অবস্থিত ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ১০০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত হয়। আজ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বরাদ্দ দেওয়া হয়নি যন্ত্রপাতি। ১০০ শয্যায় উন্নীত হলেও বাড়েনি বরাদ্দ ও ওষুধ সরবরাহ। আগের ৩১ শয্যার বরাদ্দ দিয়েই চলছে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থ্যা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের কাছে কয়েক দফা আবেদন-নিবেদন করেও কোনো ফল পায়নি বলে দাবি তাদের।
কাশিয়ানী ও পার্শ্ববর্তী আলফাডাঙ্গা উপজেলার প্রায় চার লক্ষাধিক লোক চিকিৎসা নিয়ে থাকেন এই হাসপাতালে। এ ছাড়া এ উপজেলা একটি বিরাট অংশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-খুলনা মহা-সড়ক এবং একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক। প্রায় সড়ক দুর্ঘটনার রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয় এখানে। যে কারণে হাসপাতালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ, এখানে প্রয়োজন মতো ওষুধ মেলে না। বেলা ১২টায় পরে গেলে কোনো ধরনের গ্যাসের ওষুধ পাওয়া যায় না। যেসব ডাক্তার কর্মরত আছেন তাদের অধিকাংশই ইচ্ছেমাফিক হাসপাতালের চেম্বারে বসেন এবং চলে যান। আবার অনেকেই ইচ্ছেমাফিক সপ্তাহে তিন থেকে চার দিনের বেশি হাসপাতালে আসেন না। ফলে রোগীরা ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার বেলা ১০টায় এ প্রতিবেদক সরেজমিন দেখতে পান, কাশিয়ানী ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের অধিকাংশ ডাক্তার ছিলেন অনুপস্থিত। তাদের রুমে ঝুলছে তালা। সাজাইল ইউনিয়নের আমডাকুয়া গ্রাম থেকে আসা রোগী হারুনার রশিদ বলেন, 'সকাল থেকে বসে আছি, ডাক্তারের দেখা পাইনি।' মাহমুদপুর ইউনিয়নের গোয়াল গ্রাম থেকে আসা রোগী মুজিবুল হক তার শিশু বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছেন সকাল নয়টা থেকে। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, 'আমার মেয়ের কানে সমস্যা ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেয়।'
ভর্তি রোগী আমবিয়া এবং আরাফাত মোল্যা বলেন, সারাদিনে একবার ডাক্তার আসেন। রোগীর স্বজনরা বললেও কোনো লাভ হয় না।
এ ব্যাপারে কথা বলতে গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন জিলস্নুর রহমানের মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন ধরেননি।
ওষুধ সরবারহের ব্যাপারে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর.এম.ও) ডাক্তার আমিনূল ইসলাম জানান, 'প্রতিদিন আউটডোরে নির্দিষ্ট পরিমাণের ওষুধ দেওয়া হয়। রোগী বেশি হলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। আমরা যে বরাদ্দ পাই, তা দিয়ে এক বছর চালাতে হয়।'
অন্যদিকে, হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালে দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক রয়েছেন একজন। একটি ব্যবহৃত হলেও অপরটি হাসপাতালের গ্যারেজে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। প্রয়োজনের সময় রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স পান না। ফলে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বাইরের থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে হচ্ছে।
হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, যেসব ওষুধ বেশি প্রয়োজন হয় সেগুলো সরবাহ কম। আর অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সরবারহ বেশি দেওয়া হয়। অনেক সময় সরবরাহকৃত ওষুধের মেয়াদ কম থাকায় কয়েক দিনের মধ্যেই মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
হাসপাতালটিতে অ্যানালগ ও ডিজিটাল এক্সে, ইসিজি, রক্ত, মলমূত্রসহ বিভিন্ন পরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ান থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকরা বাইরের প্যাথলজিতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ফলে বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হাসপাতালের চেয়ে খরচ হয় অনেক বেশি। হাসপাতালটিতে সিজারসহ বেশকিছু অপারেশন করা হলেও ওটিতে দ্বায়িত্বরত নার্সদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলেই (দেনদরবার না হলে) বিপদে পড়তে হয়। যোগাযোগ করলে ওটি ও অপারেশন পরবর্তী প্রয়োজনীয় ওষুধ মেলে।
হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও সহকারী পরিচালক ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, হাসপাতালটি ৩১ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হলেও প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকের কম লোকবল থাকায় আমরা আশানুরূপ সেবা দিতে পারছি না। হাসপাতালে মোট-৬৪ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ২৪ জন। ৩৫ নার্সের স্থলে কর্মরত আছেন ২৭ জন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ১৪৫ জন কর্মচারীর স্থলে আছেন ৯৪ জন মাত্র। ডাক্তারের পদ পূর্ণ হলে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারব। আমি চেষ্টা করছি সবাইকে নিয়মের মধ্যে আনতে।