তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের নাভিশ্বাস বেড়েছে হিটস্ট্রোক ও সাপের উপদ্রব
প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের জনজীবন যাত্রাও। বাড়ছে নানা রোগ। একই সঙ্গে বেড়েছে হিটস্ট্রোক ও সাপের উপদ্রপ। তাই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। প্রতিনিদিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
আটঘরিয়া (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, চলতি দাবদাহে একদিকে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের অভাবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানীয়জলের সংকট দেখা দিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। হস্তচালিত অধিকাংশ নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন একমাত্র সাবমারসিবল পানির পাম্পই ভরসা। প্রচন্ড গরমে বিদু্যতের লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকায় মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে। তবে বেড়েছে হিটস্ট্রোক ও সাপের উপদ্রব। এ এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
আটঘরিয়ায় ৩ শতাধিক মুরগির খামার ও ছোট-বড় অর্ধশতাধিক গরুর খামারিরা পানির সংকট নিয়ে চিন্তিত। পর্যপ্ত পানি ছাড়া এসব খামার এক ঘণ্টা চলা দুরূহ। ফলে সামারসিবল পানির পাম্প সচল থাকবে কিনা তাই নিয়ে তারা চিন্তিত আছেন। অধিকাংশ হস্তচালিত টিউবয়েল ক্রমান্বয়ে অচল হয়ে পড়ছে।
ভ্যাপসা গরমে বিদু্যতের লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকায় মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। ইতোমধ্যে ২০ এপ্রিল হিটস্ট্রোকে মৃতু্যবরণ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য পাঞ্জাব বিশ্বাসের ভাজতি জামাই আলাউদ্দীন ও পারখিদিরপুর গ্রামের আজিজুল খানের বড় ফুফু।
অন্যদিকে গরমে বেড়েছে সাপের উপদ্রব। গত ২১ এপ্রিল নাগদাহ গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী সাপের কামড়ে মারা যান।
লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, সারাদেশ বয়ে চলেছে দাবদাহ। এ যেন গ্রীষ্মের প্রথম প্রহরে বৈশাখের দহনজ্বালা। আর সেই জ্বালা থেকে বাদ পড়েনি সবুজ শ্যামল প্রকৃতির পাহাড়ি জনপদও। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম কিছুতে কমছে না। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। ফলে নাজুক হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। দিনে যেমন রোদের প্রতাপ, রাতে তেমন গরম হাওয়া। বাইরে প্রচন্ড গরম, আর ঘরে লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে।
গত কয়েক দিনের তীব্র দাবদাহে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার শ্রমজীবী খেটেখাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। গরম উপেক্ষা করেই তাদের বাইরে বের হতে হচ্ছে। অনেককে দেখা গেছে, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে। আর কর্মজীবী মানুষেরও যেন কষ্টের শেষ নেই। তীব্র এ দাবদাহ আরও কিছুদিন চলতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রচন্ড গরমে বিভিন্ন হাট-বাজার, মোড়গুলোতে ভ্রাম্যমাণ তরমুজ, ডাব ও আখের রসের দোকান বসেছে। এসব দোকানে ভিড়ও বেশ। এ ছাড়া গ্রামগুলোতে গরমে অতিষ্ঠ ছোট শিশুরা পুকুর ও নদীতে নেমে ডুব-সাঁতারসহ গোসল করছে। অনেককেই দেখা গেল, গরম থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় চলাচল করতে। কাজের প্রয়োজনে যারা বের হচ্ছেন তাদের দুর্ভোগ চরমে। দিনমজুর খালেক মিয়া বলেন, অসহ্য গরমে চামড়াসহ জ্বালাপোড়া করে, মাথা ঘোরায়। পেটের দায়ে তাও কাজ করতে বের হতে হয়। লংগদুর কৃষক রহিছ আলী বলেন, রোদ দেখলেই মাথা চক্কর দেয়। তবু কাজ করতে হয়।
কাঁচামাল ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, বিক্রি দিনের বেলায় অনেক কমে গেছে। তীব্র রোদে দোকানের কাঁচামালও দ্রম্নত পচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ডাঙ্গাবাজার এলাকার মোটর সাইকেল চালক জিতেন চাকমা বলেন, পাহাড়ি এলাকা হিসেবে জানতাম একটু কম গরম পড়বে, এখন দেখি প্রচুর গরম। পাহাড় থেকে অবাধে গাছ কাটার ফল বোধহয় এই প্রচন্ড গরম। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হতে পারি না। বৃষ্টিও নাই!
মাইনী বাজারে আখের রস ব্যবসায়ী শরিফুল জানান, এই তাপে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ আখের রস পান করছেন। গত কয়েকদিন থেকে ৬০০-৭০০ গস্নাস রস বিক্রি করছেন। আগে তিনি প্রতিদিন বিক্রি করতেন ১০০-২০০ গস্নাস রস। প্রতি গস্নাসের মূল্য নিচ্ছেন ২০ টাকা।
এদিকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাঙামাটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্র রেকর্ড হয় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দিনের বেলায় রোদে কেউ বাহির হচ্ছে না। গরমে দেখা দিচ্ছে সর্দি-জ্বরসহ ডায়রিয়ার মতো অসুখ। হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কক্ষে দেখা যায় রোগীদের উপস্থিতি।
লংগদু উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী জানান, প্রচন্ড এই দাবদাহে বেশি করে পানি পান করতে হবে। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ চলাচল করা যাবে না। শিশুদের খুবই যত্নে রাখতে হবে যাতে গরমের ঘাম তাদের শরীরে বসে না যায়। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা হচ্ছে।
রাঙামাটি আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটিতে এখন বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নেই। এপ্রিল মাসের এই গরম আরও সপ্তাহখানেক থাকবে। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মৃদু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বিদু্যৎ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উপকূলীয় জনপদ পাইকগাছার জনজীবন। এবারই প্রথম মৌসুমের সর্বোচ্চ গরম অনুভব এ অঞ্চলের মানুষ। মৌসুমের সর্বোচ্চ গরম বিরূপ প্রভাব ফেলেছে দৈনন্দিন জীবন যাপনে। ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের কার্যক্রম। অস্বাভাবিক তাপমাত্রার ফলে শিশু রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে সরকারি হাসপাতালসহ সবখানেই শিশু রোগী বেড়েছে।
মসজিদকুড় গ্রামের মতিউর রহমান বলেন, 'প্রচন্ড গরমে আমার দুটো বাচ্চাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।' মির্জা আহসান উদ্দিন জানান, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শিশু সন্তানরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ৫ বছরের শিশুকন্যা গত এক সপ্তাহ যাবৎ পেটেব্যথা ও বমিজনিত সমস্যায় ভুগছে। হাবিবা বেগম জানান, তার দুই বছরের শিশু সন্তানের গত এক মাস ধরে প্রচন্ড জ্বর। চিকিৎসার পরও কোনোভাবেই যেন জ্বর ছাড়ছে না।
এ ধরনের আবহাওয়ায় এবং এমন পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার খাওয়াসহ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আলহাজ মুহাম্মদ কওসার আলী গাজী।
এদিকে, পৌরসভার বাসিন্দা ভ্যানচালক রবিউল বলেন, বৈশাখের এই তীব্র রোদের কারণে ভ্যান চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এত গরম যে রাস্তায় দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মানুষও কম বের হচ্ছে। ফলে আয় কমে গেছে।
উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা সোনিয়া বেগম বলেন, 'প্রচন্ড গরম পড়েছে। বাচ্চা নিয়ে খুবই সমস্যায় আছি। ঘরের মধ্যে গরমে থাকা যায় না। আমার সন্তান কয়েক দিন থেকে জ্বর-সর্দি ও কাশিতে ভুগছে। জানি না কবে বৃষ্টির দেখা মিলবে।'
দেশে চলমান তাপপ্রবাহ শুক্রবার থেকে আগামী সোমবার সকাল পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে জানিয়ে সারাদেশে ৭২ ঘণ্টার হিট এলার্ট দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নীতিশ চন্দ্র গোলদার বলেন, এই গরমে অপ্রোয়জনে বাইরে ঘোরাঘুরি করা থেকে বিরত থাকুন। যারা কাজের জন্য বাইরে থাকেন, তাদের ছাতা ব্যবহার বা মাথায় কাপড় দিতে হবে।