শেরপুর সীমান্তবর্তী গাড়ো পাহাড় ও টাঙ্গাইলের পাহাড়ি উপজেলা সখিপুরের শাল-গজারি বন গত কয়েকদিন ধরে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ছে। বনের জমি দখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। এর ফলে গাছ-পালা ও প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণগতমান, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতিও। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, শেরপুর সীমান্তবর্তী গাড়ো পাহাড় গত দুই সপ্তাহ ধরে আগুনে পুড়ছে বলে দেখা যায়। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা-নলকুড়া ইউনিয়নের গারো পাহাড়ে শাল-গজারির বনের অন্তত ২০-২৫টি স্থানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে পাহাড়ের পর পাহাড় আগুনে পুড়ে যায়। বিভিন্ন বনের জমি দখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে থাকে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য মতে, প্রতি বছর এ মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট গজারি গাছ (শালকপিচ), ঝুপঝাড়, লতাপাতা, পোকামাকড়, কেঁচো ও কীটপতঙ্গসহ নাম জানা-অজানা বিভিন্ন প্রাণী। জন্ম নেয় না নতুন গাছ। বিনষ্ট হয় বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতি বেড়েই চলবে।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ বনবিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের আওতায় ৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয়ের আওতায় বনভূমি রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ একর। এরমধ্যে বেশিরভাগ জমিতে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা সমৃদ্ধ বন। প্রতি বছরের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এসব গাছের পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য সড়ক পথ থাকায় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা রাতে আবার কখনো দিনেও বনে আগুন দেয়। ঝরাপাতা শুকনো থাকায় মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বছরের পর বছর চলছে বনপোড়ানোর এমন ঘটনা।
গত বৃহস্পতিবার ঝিনাইগাতী-কামালপুর সড়কের ময়মনসিংহ বনবিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের চারটি স্থানে বড় আকারে আগুন জ্বলছে। আবার দুইটি স্থানে অল্প অল্প জ্বলছে। স্থানীয়রা বলেন, কে বা কারা ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে শাল-গজারি বনের কমপক্ষে ২০-২৫টি স্থান পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
গান্ধী গ্রামের বাসিন্দা আ.হানিফ মিয়া বলেন, বনের ভেতরে অসংখ্য রাস্তা রয়েছে। কে কখন কোন রাস্তা দিয়ে এসে আগুন দিচ্ছে, তা বোঝার উপায় থাকে না। এতে করে হাতির খাবারও নষ্ট করছে। এরফলে হাতিগুলো সহজেই খাবারের খোঁজে বাড়ি-ঘরে হামলা করছে, মারছে মানুষ। তবে কিছুদিন ধরে মাঝেমধ্যেই বনের ভেতর আগুনের দেখা মিলছে।
রাংটিয়া এলাকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'আপন শিক্ষা পরিবার'র পরিচালক মো. রহমত আলী বলেন, প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। মাঝেমধ্যে বিট কার্যালয়ের আশপাশের বনেও আগুন জ্বলতে দেখি। এরপরেও এসব বন্ধের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না বনবিভাগকে।
বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি ঝিনাইগাতী শাখার সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বলেন, যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থে জীবনের উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে ছোট-বড় প্রাণী, গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ করছে। এসবের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। এর প্রমাণ বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই খরা, বন্যা ও পশু-পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। জরুরিভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে পরিবেশ ও বন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল করিম বলেন, বর্তমানে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে দুই-তিন ইঞ্চি উঁচু স্তরে জমা আছে। এতে আগুন ধরিয়ে দিলে তা দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ছে। বনের ভেতর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আমার অল্পসংখ্যক স্টাফ নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, শাল-গজারির বন বনানীতে ঘেরা এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গাইলের পাহাড় এলাকা সখীপুর। যেদিকে চোখ যায় সবুজের সমারোহ। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখ মাস এলেই দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে সখীপুরের শাল-গজারির বন। বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া যেখানে প্রবেশ নিষেধ, সেখানে ঘটছে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা। প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট শালকপিচ, ঝোপঝাড়, পোকামাকড়, কেঁচো ও কীটপতঙ্গ। বিনষ্ট হয় বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। বন পোড়ানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। বিলুপ্ত হচ্ছে বন্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখি। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
গত এক মাসে সখীপুরের বনাঞ্চলে অন্তত অর্ধশতাধিক বনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার বিকালে উপজেলার বহেড়াতৈল বিটের আওতায় ছাতিয়াচালা সাইনবোর্ড এলাকায় একটি গজারি বনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রায় পাঁচ একর গজারির বন আগুনে পুড়ে যায়।
হতেয়া রেঞ্জাধীন কার্যালয়ের আওতাধীন অন্তত চারটি স্থানে শাল-গজারির বনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। কালিয়ানপাড়া, গজারিয়া, কীর্ত্তনখোলা বংকি এলাকায় শাল-গজারির এসব বনে আগুন দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৮ থেকে ১০ একর বন পুড়ে যায়। নলুয়া বিটের আওতাধীন দেওদীঘি বাজারের পশ্চিম পাশে দুটি গজারির বন, নলুয়া বিট কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকে ৩০০ গজ দূরে একটি, ঘেচুয়া এলাকায় দুটি ও আমেরচারা এলাকায় একটি বনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
গত ২৪ এপ্রিল গজারিয়া বিটে সখীপুর-সিডস্টোর সড়কের কীর্ত্তনখোলা এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি বনে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, গত এক সপ্তাহে অন্তত চারটি শাল-গজারির বন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সখীপুরে ৪টি রেঞ্জের আওতায় ১৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার একর জমিতে শাল-গজারির বন রয়েছে। বসন্তে, তথা ফাল্গুন-চৈত্র ও বৈশাখ মাসে প্রকৃতির নিয়মে শাল-গজারির পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের আশপাশের বাসিন্দারা জমি দখল ও লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাতে, আবার কখনো দিনেও বনে আগুন দেয়। ঝরা পাতাগুলো শুকনো থাকার কারণে মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে নলুয়া বিট কর্মকর্তা সাফেরুজ্জামান বলেন, 'দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি গজারির বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। আমরা খুবই সতর্ক অবস্থায় আছি। এতে গতবারের চেয়ে বনে আগুন লাগার ঘটনা কম ঘটেছে। আমার কার্যালয়ে তিনজন স্টাফ রয়েছেন। চার-পাঁচ হাজার একর জমির বন দেখভাল করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।'
বনাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বনের কাছাকাছি নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। তারা লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেক সময় গজারি বনে আগুন দিয়ে থাকেন। কেউ বনের জমি দখলের উদ্দেশ্যে বন পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকেন। বনের ভেতরের সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরাও অনেক সময় বনে আগুন দেন। মূলত জমিদখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতেই আগুন দিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা।
হতেয়া রেঞ্জের গজারিয়া বিটের আওতাধীন কীর্ত্তনখোলা গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম রিপন জানান, এভাবে বনে আগুন দিয়ে বন ধ্বংস করলে সেটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অসতর্কতার কারণেই বনে আগুন দিচ্ছে।
সরকারি মুজিব কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুনির্মল চন্দ্র বসু বলেন, বনে আগুন দেওয়ার ফলে যেভাবে বন্য পশুপাখি-কীটপতঙ্গ ধ্বংস হচ্ছে তাতে পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য।
বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, বনে কে বা কারা কখন আগুন দেয় আমরা বুঝে উঠতে পারি না। তবে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।