দেশে চলছে গ্রীষ্মকাল গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর গরমে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। এ তীব্র গরমে মাটির ঘর যেন গরিবের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র গরমেও মাটির ঘরের ভেতরে বিরাজ করে ঠান্ডা। তাই গরিব মানুষের জন্য এসব মাটির ঘর যেন এসি।
একটা সময় এ দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামেই মাটির ঘর পাওয়া যেত। দেশে মাটির ঘর প্রায় বিলুপ্তির পথে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের মতো কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা শান্তির নীড় মাটির ঘর।
মাটির ঘরের কদর কমিয়ে দিয়েছে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব মাটির ঘর ঠান্ডা থাকায় এক সময় এটাকে গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরও বলা হতো। এ ঘর গরমের সময় আরামদায়ক। তাই অনেক গ্রামেই বিত্তশালীদের দোতলা মাটির ঘরও ছিল।
এ উপজেলার অনেক গ্রামে এখনও রয়েছে মাটির ঘর। উপজেলার সিদলা, ধূলজুরী, পুমদিসহ কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে কয়েকটি মাটির ঘর চোখে পড়েছে। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী মাটির ঘর। এসব ঘর শুধু মাটির বাড়িই নয়, ছিল ধান-চাল রাখার জন্য মাটির তৈরি গোলা ঘর ও কুঠি।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় এক সময় প্রায় প্রতিটি ঘর ছিল মাটির তৈরি। কিন্তু আধুনিকতার স্পর্শে এখন মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদু্যৎ। গ্রামীণ অর্থনীতির গতি সচল হওয়ায় মাটির ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে পাকা ঘর। কয়েক বছর পর পর মাটির ঘর সংস্কারের ঝামেলা ও ব্যয়বহুল দিক পর্যবেক্ষণ করে মাটির ঘরের পরিবর্তে দালান-কোটা বানাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এখানকার মানুষ।
উপজেলার ঢেকিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিন জানান, মাটির ঘর তৈরি করতে প্রথমে এটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগত দেড় থেকে দুই মাস। একসময় আমাদের এলাকার প্রতিটা ঘর মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো। অনেকেই মাটি, বাঁশ ও টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরি করত।
তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির বাড়ি শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু কালের বিবর্তনে ইটের দালানকোটা আর বড় বড় অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির বাড়িঘর। মাটির ঘরে দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের শিলিং তৈরি করে তার ওপর খর বা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। মাটির বাড়িঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। মাটির ঘর বড় মাপের হয় না। গৃহিণীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির বাড়িঘরের ক্ষতি হয় বলে বর্তমান সময়ে দীর্ঘ স্থায়িত্বের কারণে গ্রামের মানুষ ইটের বাড়ি নির্মাণের আগ্রহী হচ্ছেন।
উপজেলার ধূলজুরী গ্রামের গৃহিণী জেসমিন বেগমের বাড়িতে আজও মাটির ঘর আছে। তিনি জানান, অর্থ সংকটে আজও তার টিনের ঘর তৈরি করা হয়নি। স্বামীর তৈরি করা মাটির ঘরটিতেই সন্তান স্বামী নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। তাদের পূর্ব পুরুষরাও এই মাটির তৈরি বাড়িতেই জীবন কাটিয়ে গেছেন।
হোসেনপুর আদর্শ মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আশরাফ হোসেন সোহাগ জানান, মাটির বাড়ি বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের পরিবর্তনে আধুনিকতার সময় অধিকাংশ মানুষ মাটির বাড়ি ভেঙে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প জায়গায় দীর্ঘ স্থায়ীভাবে অনেক লোকের নিবাসকল্পে গ্রামের মানুষরা ইটের বাড়িঘর তৈরি করেছেন। অনেকেই শখ করে আবার অনেকেই বাড়ি করার অর্থবিত্ত না থাকায় মাটির বাড়িতেই বসবাস করছেন।