স্বপ্নের বীজ বুনছে যমুনার চরে। নানা ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে ওখানকার বানভাসি মানুষ। মরিচ, ভুট্টা, পাট, বাদাম, মসুর ডাল, খেসারি, কাউন, খেরাচিসহ নানা ধরনের বীজেই তাদের বর্তমান ও আগামীর স্বপ্ন। পাখির কোলাহল ও ঘোড়ার ডাকের শব্দেই ঘুম ভাঙে ওখানকার মানুষের। প্রতিদিনের পরিশ্রম ছাড়া অন্ন যোগান দেওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
বলছিলাম বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার যমুনার চরের মানুষের কথা। এ চরে প্রায় ১১টি গ্রামে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। খাদ্যশস্য উৎপাদন করাই যাদের বন্যা ও পরবর্তী সময়ে জীবিকা নির্বাহের মূল অবলম্বন। ওখানে উলেস্নখযোগ্য ফসলগুলোর মধ্যে ভুট্টা অন্যতম। এই ফসলকে চরের স্বর্ণও বলা হয়ে থাকে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে চরাঞ্চলেই চাষ হয়েছে ৩০০ হেক্টর।
সরেজমিন উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের পূর্ব তেকানীসহ চরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষ সব থেকে লাভজনক। অর্থাৎ অন্যান্য ফসলগুলোতে নানা ধরনের রোগবালাই ও ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত নানা ধরনের ভয় থাকলেও ভুট্টা চাষ একেবারেই শংকা মুক্ত। কারণ, এ সময়ে নেই বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অন্যদিকে ভু্ট্টা চাষের জন্য শীতকাল বেশ উপযোগী।
এসব কৃষকের মধ্যে হারুন অর রশিদ বলেন, 'আমি গত বছর সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করি। তাতে ১২০ মণের বেশি ফলন হয়েছে। গত বছরে ৮শ' থেকে ১১শ' টাকা পর্যন্ত বাজার দর পেয়েছি। এ বছর আবারও ভুট্টা চাষ করছি। অন্যান্য ফসলের চেয়ে ভুট্টা চাষে পরিশ্রম কম এবং বাজার দর ভালো পাওয়া যায়।' একই গ্রামের তারেক বলেন, 'গত বছর ৩ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করলেও এবার ৭ বিঘায় করেছি। রাণীর পাড়া গ্রামের জিলস্নুর রহমান বলেন, আমি গত বছর ১০ কাঠা জমিতে ভুট্টা চাষে ২০ মণ ফলন পাই। এ বছর ১ একর জমিতে ভুট্টা করেছি।'
পাকুল্যা ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কৃষক আনারুল বলেন, 'আমি গত বছর ১০ শতাংশ জমিতে ভুট্টা চাষ করে ভালো ফলন ও বাজারদর পাওয়ায় এ বছর সাড়ে ৩ বিঘা আবাদ করেছি। প্রতি বিঘায় প্রায় ৫৩ মণ ভুট্টা পেয়েছি। ভুট্টা চাষই আমার কাছে সব থেকে নিরাপদ ফসল মনে হয়।'
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু জমিতে মাষকালাই চাষ করলেও বেশিরভাগ জমি প্রস্তুত করে নেওয়া হয় ভুট্টা ও মরিচ চাষের জন্য। ভুট্টা বীজ বপন থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রায় ১০০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। এর মধ্যে আগাম ও উফশী ভুট্টা চাষে কৃষকের আগ্রহ বেশি। ফলন কম হওয়ায় দেশীয় জাতের ভুট্টা চাষ বর্তমানে নেই বললেই চলে। চরে এবার বাদশা-৫৫৫, থ্রি গোল্ড, বর্ণালী, মোহরসহ বিভিন্ন জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়েছে। হাইব্রিড ভুট্টা চাষে ফলন বেশি পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষে প্রায় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। ভালো ফলন হলে জমির প্রকার ভেদে বিঘাপ্রতি ৩৫ থেকে ৫০ মণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ হাজার টাকা মণ হলেও প্রতি বিঘা থেকে অন্তত ৩০ হাজার টাকা ঘরে তুলতে পারেন কৃষকরা।
ভুট্টা চাষে কিছু রোগ থাকলেও তা কৃষকদের একটু নজরদারিতে রেখে পরিচর্যা করলেই এসব রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, 'ভুট্টা একটি লাভজনক ফসল। সোনাতলা উপজেলায় এ বছর ৪৫০ হেক্টর ভুট্টা চাষ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৭৫ হেক্টর বেশি। ভুট্টার বাজার দরও এখন বেশি। ভুট্টা দিয়ে উন্নতমানের খাবার তৈরি হয়। শুধু মানুষের খাবার ছাড়াও গবাদি পশু, মাছের খাবার ও বাচ্চাদের বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ভুট্টার ব্যবহার হয়। ভুট্টা দিয়ে এখন উন্নতমানের সাইলেজ তৈরি হচ্ছে। এতে করে গরু পালনে খরচ কমে যাচ্ছে। তাই ভুট্টা চাষ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে ভুট্টা চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
উপজেলার অন্যান্য এলাকায় ভুট্টার ফসল থাকলেও পাকুল্যা ও তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চরাঞ্চলে ধু-ধু বালুর পরিবর্তে বর্তমানে দৃষ্টি জুড়ে চরের বিস্তর এলাকাজুড়ে শুধু ভুট্টার ক্ষেত। বন্যা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ফসল ফলনের মাধ্যমে অনেক বেকার এখন স্বাবলম্বী। এসব ফসলের মধ্যে ভুট্টা অন্যতম। তুলনামূলক ভুট্টা চাষে কৃষকের অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।