তীব্র দাবদাহে বিপাকে বুড়িগঙ্গার মাঝিরা

প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর তীড়ে তীব্র তাপদাহে অলস সময় কাটাচ্ছেন মাঝিরা -যাযাদি
বৈশাখের শুরু থেকেই গ্রীষ্মের রুদ্ররূপ দেখছে রাজধানীসহ সারাদেশ। তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝিরা। সারাদিন নৌকা চালিয়ে কতই বা আসে, তিনশ' থেকে চারশ' টাকা। আর এ আয় টক্কর দিতে পারে না নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে। আবার সেখানে তীব্র গরমে মাঝিদের দিনযাপন এখন জটিল। তবুও জীবিকার তাগিদে মাঝিরা টিকে থাকার লড়াইয়ে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে বাইছেন নৌকা। মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে বুড়িগঙ্গার সদরঘাটের লালকুঠি, ওয়াইজঘাট, বাদামতলী, শ্যামপুর, সোয়ারী, তৈলঘাট ও জিনজিরা ফেরিঘাট ঘুরে দেখা যায়, তীব্র গরমে বহু নৌকা বেকার পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন ঘাটে নৌকা চালিয়ে জীবিকা চালান প্রায় পাঁচ হাজার মাঝি। অনেকে পেশা ছেড়ে কুলি কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। অন্যরা যারা 'মায়ায়' পড়ে আছেন, আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান আগানগর ঘাটের মাঝি দিদার হোসেন। তিনি বলেন, 'রোদের তাপে চোখ মেলে তাকানোই যেন দায়। মোবাইল ম্যাপে ৩২ ডিগ্রি দেখালেও তাপপ্রবাহ যেন ৪০ সমান। তবুও জীবিকার তাগিদে নৌকা হাতে বেরিয়েছি।' বাদামতলি ঘাটের মাঝি আরফত আলী বলেন, নৌকা টানতে গিয়ে কায়িক শ্রমে অনেকটা সয়ে যাওয়া শরীরও কাহিল হয়ে পড়ছে তার। ঝরে পড়া ঘামের স্রোত যেন জানান দেয় আর সইছে না এই তাপ। এমনি চিত্র দেখা যায় বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে মাঝিদের। হাঁসফাঁস করা গরমে কাহিল হওয়া শরীর চাঙা করতে শুধু পানি আর ঘাটের টঙের শরবত দিয়েই বারবার শুষ্ক গলা ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তাদের। এ সময় রোগশোকে আক্রান্ত হলে তা প্রতিরোধে পুষ্টিকর খাবার কিংবা ওষুধ কিনতে যে পরিমাণ আর্থিক সচ্ছলতা প্রয়োজন তা অধিকাংশ মাঝির নেই। তৈলঘাট এলাকায় মাঝি শামসুল আলম বলেন, 'আগে সারাদিন নৌকা বাইতাম। এখন বেশি বাইতে পারছি না। এই গরমে আমাদের খুব কষ্ট হয়। আর যেটুকু পারি সেটুকু আয়ে দুবেলা ভাত খাই, ভালো খাবার কোথায় পাব?' এ ঘাটের শফিফুল মাঝি বলেন, জীবিকার তাগিদে সকালবেলা নৌকা নিয়ে বের হয়েছেন। ততক্ষণে বাড়তে শুরু করেছে রোদের তীব্রতা। এ তীব্র রোদে আর এগোতে পারছেন না, তাই ক্লান্তি ভরা শরীর নিয়ে নৌকায় বসে ঝিমাচ্ছেন। গরমে কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, গরমে মাথা ঘুরাচ্ছে। একটা ভাড়া টানলেই শরীর একদম ক্লান্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে নৌকা চালান। বড় কোনো ভাড়া টানতে পারেন না। ৩০ থেকে ৪০ টাকার ভাড়া টানেন। গরম না থাকলে নৌকায় আটজন নিয়েও চলতেন। এখন দুইজন যাত্রী নিয়ে চালাতে কষ্ট। বেশির ভাগ সময় একজন নিয়ে চালান। এই মাঝি আরও বলেন, গত এক সপ্তাহ থেকে দূরের কোনো ভাড়া কিংবা চারজনের বেশি যাত্রী টানতে পারছেন না তিনি। গরমে বেশি ভাড়া টানতে না পারায় আগের চেয়ে আয়-রোজগার কমেছে, অন্যদিকে খরচও বেড়েছে নিত্যদিনের। জিনজিরা-কামরাঙিরচর ঘাটের ষাটোর্ধ্ব হারুন মোলস্না মাঝি বলেন, সকালবেলা রোদ ওঠার আগে ভাড়া টানা যায়। বেলা গড়িয়ে রোদ বাড়ার পর আর পারেন না। যতক্ষণ চালান, মাথায় গামছা বেঁধে চালান। এদিকে গরমে মানুষও বের হচ্ছে কম। যারাই আছে, ভাড়া আছে ভালো। কিন্তু গরমে শরীর আর হাত চলে না। এসময় সদরঘাট এলাকার আবুল শেখ মাঝি জানান, এখন আর আগের দিন নেই। নৌকা আর ঘাট বেড়েছে। আগের মতো যাত্রী বা মালামাল পাওয়া যায় না। আজ থেকে ১০ বছর আগেই যেখানে দৈনিক আয় হতো ৮০০-৯০০ টাকা। সেই পরিমাণ এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ঘাট ভাড়া, সিরিয়াল, নৌকার রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন বাবদ প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুইশ' ৫০ টাকা খরচ হয়। এই খরচটা আরও কম হলে আমাদের পোষাত কিছুটা। তীব্র এই গরমে অনিয়ন্ত্রিত পরিশ্রমের ফলে একজন মানুষের শরীরে পানিশূন্যতা, মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, হিট স্ট্রোক, চর্মরোগ, ডায়রিয়া বা বদহজম, টাইফয়েড ও হেপাটাইসিস, সর্দি-কাশিসহ নানাবিধ রোগ দেখা দিতে পারে। এ বিষয়ে পুষ্টিবিদ সাফাতুন্নেসা বলেন, এই সময়ে রোগ প্রতিরোধে শরীরের জন্য দরকার বাড়তি যত্ন। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার প্রয়োজন। এর কমতি হলে মানসিক, শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশির মৃতু্যর ঝুঁকি রয়েছে। শুধু স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিই না, তীব্র গরম শ্রম অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, তীব্র গরমে মানুষজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কেউ মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় নৌকার মাঝিদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রোগে যারা ভুগছেন তারা যেন নেহাত বাসা থেকে না বের হন। অন্যদিকে নৌকা নিয়ে বের হওয়ার সময় বোতলে যেন বিশুদ্ধ পানি নেন। কেননা তীব্র গরমে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। এ সময় পানি না খেলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এ কারণে পানি এবং ওরস্যালাইন প্রয়োজনমতো পান করতে হবে। গরমে আঁটসাঁট জামা কাপড় না পরে সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে।