খুলনার সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের অধীনে বন বিভাগের লাউডোব টহল ফাঁড়ির ঠিক অপর পাশেই বনলতা নামে রিসোর্ট তৈরি হয়েছে। নামে ইকো রিসোর্ট হলেও রুম প্যাসেস খাবার স্থান এবং ওয়াশ রুমের মেঝেতে কনক্রিটের টাইলস বসানো। সুন্দরবনের মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যে রিসোর্টটিতে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় দেওয়া সাউন্ডবক্সে বাজানো হচ্ছে ডিজে গান।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা একটি পরিবার জন্মদিন পালন করছিলেন এখানে। রিসোর্টের ভেতরে মাত্র তিনটি রুম এবং সুন্দরবনমুখী খোলা জায়গা। জনপ্রতি দুইশ' টাকা দিয়ে রিসোর্টের ব্যবস্থাপনায় নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সুন্দরবনের ভেতরে। রিসোর্টটির রুমের নিচে ব্যবহার্য চিপস-এর প্যাকেট, পস্নাস্টিকের বোতল জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে বনের ভেতরে। মাত্র একশ' গজ দূরে থাকা বনবিভাগের টহল ফাঁড়ি এর কিছুই জানে না। শুধু বনলতা নয়। সম্প্রতি খুলনার দাকোপের কৈলাশগঞ্জ ও বানিয়াশান্তা ইউনিয়নে সুন্দরবনের একেবারে কোলঘেঁষে গড়ে অন্তত ১২টি রিসোর্ট। সামাজিক মাধ্যমে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে রিসোর্টগুলো পর্যটক টানছে প্রতিনিয়ত।
আইনের তোয়াক্কা না করে একে একে রিসোর্ট তৈরি করায় দৃশ্যমান যে চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে একদিকে বন ধ্বংস হবে, অন্যদিকে বনে ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও পড়তে হবে ঝুঁকিসহ নানা বিড়ম্বনায় বলে মনে করেন সুন্দরবন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ও বানিয়াশান্তা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, এখানে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠছে একাধিক রিসোর্ট। এর মধ্যে বনলতা ও ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন নামে দুটি রিসোর্ট কৈলাশগঞ্জে। বাকি রিসোর্টগুলো বানিয়াসান্তায়। সেখানে ঘুরে দেখা যায়, বনবাস, ইরাবতি, মাটির ময়না, জঙ্গলবাড়ী, পিয়ালি, নির্বাসন, সুন্দরী, বনবিবি। এছাড়া কয়েকটি রিসোর্টেও নির্মাণ কাজ চললে এখনও নাম নির্ধারণ করা হয়নি।
একের পর এক রিসোর্ট নির্মাণ হওয়ায় হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনের লাউডোব টহল ফাঁড়িতে সিপিজি হিসেবে কাজ করা শর্মিলা জানান, বন ও লোকালয় এক জায়গায় হওয়ায় সেখানে বন রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখন একের পর এক রিসোর্ট তৈরি করে প্রচুর মানুষ প্রতিনিয়ত সুন্দর বনে কোনো অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করছে। ভেতরে প্রবেশ করে ব্যবহার্য পস্নাস্টিকের বর্জ্য ফেলছে, উচ্চস্বরে গান বাজাচ্ছে, বিভিন্নভাবে বনের ক্ষতি করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে তারা এসব করছে। বনবিভাগ বা কাউকে তারা তোয়াক্কা করে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে অবাধ বিচরণের বিষয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ আইন-২০১৪ আছে, যেটা ভ্রমণকারীরা অবশ্যই মানতে বাধ্য। সরকারের এই মুহূর্তে একটি প্রজেক্ট চলছে যেটা সুরক্ষা প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের আওতায় ইকো-টু্যরিজম একটা বিষয় আছে। কিন্তু একটি কটেজ করতে হলে অনেকগুলো বিষয় মানা উচিত। এটার একটা নীতিমালা থাকা উচিত। যেহেতু এখনো কোনো নীতিমালা তেমন নাই সুতরাং অচিরেই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এ বিষয় আমার পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। তবে এই বিষয়টি নিয়ে বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের দায় এড়ানো বা সমন্বয় হীনতার কোনো সুযোগ নাই।
কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিহির রঞ্জন অধিকারী বলেন, 'আমার এলাকা এবং বানিয়াশান্তা এলাকায় মোট ৩৫টি রিসোর্ট হয়েছে। এর কয়েকটি আমার এলাকায় আমরা শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছি। তবে ম্যানগ্রোভ হ্যাবেন নামে আমাদের একটি রিসোর্ট রয়েছে যা ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল। ইকো ক্রিটিক্যাল এরিয়ার ভেতরে স্থাপনার অনুমতি দেওয়ার আগে সব কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এই বিষয়ে আমার তেমন কোনো জানা নেই।
খুলনা বিভাগীয় বন অফিসের সদর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসান বলেন, 'বনে আমাদের একটা নির্দিষ্ট সীমানা আছে। এর এক ইঞ্চি দূরেও যে কেউ কোনো কিছু করলে এটা দেখার এখতিয়ার আমাদের না। বনের মধ্যে ঢুকে কেউ কিছু করলে আমাদের প্রমাণ দেন। আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা এসব বিষয় সমন্বয় মিটিংয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলার চেষ্টা করলে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের কথা শোনে না। আমাদের এখানে কিছু করার নেই।'
দাকোপ ইউএনও জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, 'রিসোর্ট কয়েকটি হয়েছে আমি আসার আগেই। তবে কেউ কোনোদিন কোনো ধরনের অনুমতি নিতে আসেনি। এগুলো করতে কোনো অনুমতি আদৌ লাগে কি না বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি আমরা অবশ্যই খোঁজ নেব। তবে বন বিভাগের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে মিটিং আহ্বান করলে বন বিভাগ আসে না। আমাদের কিছু জানায় না। আমরা তাদের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাই না।'