নানা প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যতার মধ্যেও জীবন সংগ্রামে উদ্যোমী অনেক নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে সমাজ ও দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যারা কঠিন সংগ্রামে যোগ্যতা অর্জন করে চাকরি ও স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে নিজেরা হয়েছেন স্বাবলম্বী, এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন অন্যদেরও। কিন্তু জীবন সংগ্রামে বিজয়ী তাদের প্রতিষ্ঠা লাভের দুর্বিসহ গল্প জানে না অনেকেই।
মধ্যবিত্ত পরিবারের নিরক্ষর মা ও অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন বাবা-মার কোলজুড়ে পৃথিবীতে আসেন আজকের সফল নারী, স্ত্রী, মা ও শিক্ষক উপজেলার ধরমপুর গ্রামের রিজিয়া খাতুন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। গ্রাম অঞ্চলের নানা বাধা ঠেলে পড়াশোনা করতে হয়েছে। নিজের পড়া-লেখার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। বাল্যবিয়ের হাত থেকে বাঁচতে হয়েছে বহুবার। কষ্ট আর সমাজের নানা বাধা অতিক্রম করে আজ তিনি একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৯৯৮ সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার পর দুই হাত দিয়ে শুধু কুড়িয়েছেন প্রশংসা আর কর্মদক্ষতার সম্মাননাপত্র ও ক্রেস্ট। তিনি বিবাহিত জীবনে এক ছেলে এক মেয়ের মা। ছেলে বুয়েটে ও মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। স্বামী মো. নুহু শেখ সরকারি কলেজের শিক্ষক। সমাজের সব বাধা ঠেলে লেখা-পড়া মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জে সফল হয়েছেন বলে জানান রিজিয়া খাতুন।
বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির অবস্থা খুব খারাপ ছিল ঝাউবোনা গ্রামের সাবিরুল ইসলামের স্ত্রী ফাইমা বেগমের। বিয়ের পর পৃথক করে দেয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। বিপাকে পড়তে হয় সংসার চালানো নিয়ে। স্বামী দিনমজুর। সংসারে টানা-পড়েন লেগেই থাকে। এ সময় হাল ধরতে হয় ফাইমাকে। চরকার চাকা ঘুরিয়ে শুরু করেন রেশম পোকার গুটির ছাঁট দিয়ে সুতা তৈরির কাজ। স্বামী-স্ত্রীর বিন্দু বিন্দু আয় দিয়ে দিন চলে যায়। এমন সময় কোলজুড়ে আসে পরপর দুই কন্যাসন্তান। মেয়েরা বড় হয়, কিন্তু তাদের পড়ানোর মতো সামর্থ ছিল না। এক মেয়েকে ব্র্যাক অপর মেয়েকে প্রশিকা স্কুলে ভর্তি করে পড়া-লেখা করাতে থাকেন। পরে টানা-পড়েনের সংসারে পরিশ্রম করে এক মেয়ে ভালো ফলাফল করলে আইন বিভাগে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ পান। অপর মেয়ে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্নি করছেন। বর্তমানে সংসার জীবনে কঠিন পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মেয়ে দুইজনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলে জানান ফাইমা বেগম।
ভোলাহাট উপজেলার পোলস্নাডাংগা লম্বাটোলা গ্রামের মো. আশাদুলের স্ত্রী মাহামুদা খাতুন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে বিয়ের পিড়িতে বসেন। দরিদ্র স্বামীর অল্প আয়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। এ সময় আবার এক কন্যা ও পুত্র সন্তানের মা হন। সংসারে আরও ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ে না। বাধ্য হয়ে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়েন মাহামুদা। বিভিন্নভাবে অর্থ জোগাড় করে ১০টি গরু কিনে খামার তৈরি করেন। এই খামার থেকে আয় আসতে থাকলে সংসারের অভাব দূর হতে থাকে। সেই সঙ্গে এলাকায় বেশ পরিচিতি ঘটতে থাকে। ২০২১ সালে দলদলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি। জনসেবা ও গরুর খামার অব্যাহত আছে তার। তিনি বলেন, এখন বেশ ভালো আছেন। জনসেবা আর নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মমর্যাদা বেশ বেড়েছে।
উপজেলার কানারহাট গ্রামের মামুন অর রশিদের স্ত্রীর মহরমী খাতুন দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার পরিবারে ছয়জন সদস্য থাকায় তিনবেলা খাওয়ার অভাব ছিল। বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো সমর্থ ছিল না বাবার। কষ্টের সংসারে মনের জোরে এসএসসি পাস করেন। এরপর আর পড়ালেখা ভাগ্যে জোটেনি। এর মধ্যে সংসারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি বাবা মারা যান। শুরু হয় জীবন যুদ্ধের লড়াই। বাচ্চাদের টিউশানি আর এলাকার লোকজনদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া থেকে কিছু আয় হতো। এরই মধ্যে ২০০৩ সালে বিয়ে হয়। স্বামী সংসারে গিয়ে সংসার গোছানোর হাল ধরেন তিনি। এমন সময় কোলে আসে এক পুত্র সন্তান। ছেলেটি পড়া-লেখা করছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। বিভিন্ন সমাজসেবামূল কাজে জড়িয়ে এলাকায় বেশ পরিচিতি লাভ করেন মহরমী। ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে ভোটে অংশ নিয়ে জয় লাভ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সংসার জীবনে কষ্টের পর স্বচ্ছল ভাবে বেঁচে আছেন। সেই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেশ সম্মানের সঙ্গে জনগণের পাশে থেকে উন্নয়নমূলক কাজ করছেন।