মারমা সম্প্র্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব সাংগঁ্রাই। এই উৎসবের মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানায় মারমারা। এ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বইছে উৎসবের আমেজ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নতুন পোশাকসহ নানা কেনাকাটা, ঘরবাড়ি সাজসজ্জার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
কাপ্তাই (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, নববর্ষকে বরণ এবং পুরনো বর্ষকে বিদায় উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমা সম্প্র্রদায় সাংগ্রাঁই জল উৎসব বা সাংগ্রাঁই রিলংপোয়ে উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। মারমা যুবক-যুবতীরা একে অপরের প্রতি জল ছিঁটিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ, গস্নানি, বেদনাকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী চিংম্রং বৌদ্ধ বিহারের সাংগ্রাঁই রিলংপোয়ে উদ্যাপন কমিটির আয়োজনে সোমবার সকালে চিংম্রং বৌদ্ধ বিহার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় সাংগ্রাঁই রিলংপোয়ে উৎসব ২০২৪। এ উপলক্ষে মারমা সম্প্র্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংগ্রাঁইর্ যালি, আলোচনা সভা এবং জলকেলি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা হতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে।
সাংগ্রাঁই রিলংপোয়ে উৎসব উপলক্ষে বিহার সংলগ্ন মাঠে এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং রাঙামাটির সাংসদ দীপংকর তালুকদার। এ সময় তিনি বলেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন উৎসবে মেলবন্ধ হয়, এটাই আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক সম্প্র্রদায়ের অনুষ্ঠানে সবসময় আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
জল উৎসব উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক ও চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়েশ্লিমং চৌধুরীর সভাপতিত্বে অ্যাডভোকেট হ্লাথোয়াই মারমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কাপ্তাই ৪১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আমীর হোসেন মোলস্না, কাপ্তাই ৫৬ বেঙ্গল এর অধিনায়ক লে. কর্নেল নুর উলস্নাহ জুয়েল, রাঙামাটি জেলা পরিষদ সদস্য অংসুইছাইন চৌধুরী, ইউএনও মো. মহিউদ্দিন, সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য প্রকৌশলী থোয়াইচিং মং মারমা, রাজস্থলী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল আহমেদ ভূঁইঞা। পরে অতিথিরা বিহার সংলগ্ন মাঠে জলকেলী উৎসব উদ্বোধন করেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি জানান, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা বছরের শেষ দিন এবং নতুন বছরের প্রথম ৩ দিন নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় বছরের পাপাচার, গস্নানি ধুয়ে মুছে দিতে এবং নতুন বছরকে বরণ করে নিতে যুগ যুগ ধরে 'বৈসাবি' উৎসব পালন করে আসছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান তিনটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব 'বৈসাবি'। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে ত্রিপুরা সম্প্র্রদায় 'বৈসুক', মারমারা 'সাংগঁ্রাই' এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা 'বিজু' উৎসব পালন করে। তিন উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে এই উৎসবকে বলা হয় 'বৈসাবি'।
সাংগঁ্রাই অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির সদস্যরা জানায় ১৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৩ দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে মারমাদের সাংগ্রাঁই অনুষ্ঠান।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রোববার বাংলা নতুন বছর ১৪৩১ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা ও উপজাতি সম্প্র্রদায়ের সাংগঁ্রাই উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
শোভাযাত্রায় অংশ নেন নাইক্ষ্যংছড়ি ইউএনও মোহাম্মদ জাকারিয়া, বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ক্যানেওয়ান চাক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মংলা ওয়াই মার্মা, দোছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইমরান, কৃষি অফিসার এনামুল হক, সহকারী শিক্ষা অফিসার আক্তার উদ্দিন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্মকর্তা শাহা আজিজ, থানার ওসি আবদুল মান্নান, নাইক্ষ্যংছড়ি প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাইনুদ্দীন খালেদ, আহ্বায়ক আবদুল হামিদ, সদস্য-সচিব জাহাঙ্গীর আলম কাজল প্রমুখ।
সাংগঁ্রাই উৎসব উদ্যাপন কমিটির সভাপতি ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মংলাওয়াই মারমা বলেন, তিন দিনব্যাপী সাংগঁ্রাই উৎসবে বাঁকখালী নদীতে বুদ্ধ স্নান, সমবেত প্রার্থনা, জলকেলি, পিঠা তৈরি, হাজারো প্রদীপ প্রজ্বলন, বয়স্ক পূজা এবং সম্প্র্রদায়গুলোর নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, গানসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন হয়ে থাকে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান বলেন, উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিটি স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রামগড় (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ির রামগড়ে মারমা সম্প্র্রদায়ের সামাজিক প্রধান উৎসব মাহা সাংগ্রাঁইং ম্রাইংমা সাক্র ১৩৮৫-৮৬ উদ্যাপিত হয়েছে। নতুন বর্ষবরণকে ঘিরে নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা, প্রচার প্রসার ও নতুন প্রজন্মের নিকট প্রকাশ করতে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে মারমা উন্নয়ন সংসদ কেন্দ্রীয় কমিটি। শনিবার রামগড় বিজয় ভাস্কর্য প্রাঙ্গনে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকতা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি।
মারমা উন্নয়ন সংসদের সভাপতি মংপ্রু চৌধুরীর সভাপত্বিতে সাংগ্রাঁই উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন গুইমারা সেনা রিজয়িনের কমান্ডার রাইসুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের ডেট কমান্ডার কর্নেল আব্দুলস্নাহ মুহাম্মদ আরিফ, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. শহীদুজ্জামান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরীর অপু, জেলা পুলিশ সুপার মুক্তাধর, জেলা পরিষদ সদস্য হিরনজয় ত্রিপুরা, রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারি, ইউএনও মমতা আফরিন, পৌর মেয়র রফিকুল আলম কামাল প্রমুখ।