অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করে আলোর আহ্বান
রাজধানীতে পুরোদমে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি 'এবারের আয়োজনে চারটি বড় মোটিফ বা শিল্পকর্ম তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো আমাদের লোকজ জীবনে রয়েছে। সেগুলোকেই আমরা একটু বড় করে তৈরি করি। এছাড়া মুখোশসহ নানা রকম শিল্পকর্মও থাকবে'
প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
রাজধানীসহ সারাদেশে শুরু হয়েছে বাংলা বর্ষবরণ আয়োজনের প্রস্তুতি। বাঙালির এই প্রাণের উৎসব ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় রূপ নেয়। রাজধানী রমনার বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, পুরান ঢাকার ধুপখোলা মাঠে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কাজ শুরু হয়েছে।
অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করে আলোর আহ্বান জানিয়ে এবারের বর্ষবরণ উৎসবের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। 'আমরা তো তিমির বিনাশী' প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে সকাল ৯টায়। শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে।
প্রস্তুতির সবশেষ অবস্থা জানাতে রোববার চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, "অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমরা আলোর দিশারী। অন্ধকার ভেদ করে আমরা সমাজে আলো ছড়াতে চাই। এজন্যই আমরা এবার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছি- 'আমরা তো তিমিরবিনাশী'। কবি জীবনানন্দ দাশের 'তিমির হননের গান' কবিতার পঙক্তি থেকে এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।"
এবারের আয়োজনে চারটি বড় মোটিফ বা শিল্পকর্ম তৈরি করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাবি চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, "প্রতি বছরই আমরা আমাদের লোকজ মাটির পুতুল থেকে এসব মোটিফ তৈরি করি। এবার আমরা আশা করছি চারটি মোটিফ তৈরি করা হবে। আর যদি সম্ভব হয়, পাঁচটিও হতে পারে।
"ঈদের ছুটির কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই ঢাকার বাইরে থাকবে, সেজন্য নিশ্চিত করে এখনই বলছি না। তবে চারটি হবে এটা নিশ্চিত, সম্ভব হলে পাঁচটি মোটিফ থাকবে।"
নিসার হোসেন বলেন, 'যে মোটিফ তৈরি করা হচ্ছে এগুলো আমাদের লোকজ জীবনে রয়েছে। সেগুলোকেই আমরা একটু বড় করে তৈরি করি। এছাড়া মুখোশসহ নানা রকম শিল্পকর্মও থাকবে।"
শিল্পী রফিকুন্নবী বলেন, "এবার দুটো আনন্দ একসঙ্গে। ঈদের পরপরই বর্ষবরণ। আমরা আশা করি মানুষ দ্বিগুণ আনন্দে মেতে উঠবে।"
অন্যদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
'নিরাপত্তার নামে যেন আবদ্ধ না হই'
এবারও প্রশাসন থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, "আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সব রকম সহযোগিতা করব।"
তবে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এভাবে উৎসবের আয়োজন নিয়ে আক্ষেপ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, "এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষ যেন নির্ভয়ে আসতে পারে তার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে। আবার নিরাপত্তার নামে যেন এটাকে দেখতে প্যারেডের মতো মনে না হয়। সেটিও ভাবতে হবে।"
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, "কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি নিরাপত্তার নামে পুরো শোভাযাত্রাটি ঘিরে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এটি দেখতে ঠিক শোভন হয় না। তাই অনুরোধ করব, এবার যেন একটু দূর থেকে বা অন্য উপায়ে নিরাপত্তার ব্যাপারটি ভাবা হয়, নিরাপত্তার নামে আমরা যেন আবদ্ধ না হয়ে যায়।"
বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার আগে শেষ করার নির্দেশনা 'ঠিক হয়নি' মন্তব্য করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, "অন্য সব দিবসে তো এটি বলা হয় না। তবে নববর্ষে কেন সংক্ষিপ্ত করার এই নিয়ম বেধে দেওয়া? মানুষ যেন তার মতো আনন্দ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। সময়ের ব্যারিকেড তুলে নিতে হবে।"
মুখ ঢাকা যাবে না মুখোশে
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ষবরণের সব আয়োজন বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করাসহ ভুভুজেলা বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বলেছে, তারা বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
মুখোশ নিষিদ্ধ কিনা- এমন প্রশ্নে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, "মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা যে মুখোশ তৈরি করি সেগুলো হাতে রাখতে হয়, এ ধরনের মুখোশ ব্যবহার করা যাবে। তবে নিরাপত্তার কারণে মুখ ঢেকে কোনো মুখোশ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ অনেকে মুখোশে মুখ ঢেকে নানা রকম অপরাধ মনোবৃত্তি নিয়ে আসে। এজন্য মুখোশ ব্যবহার করা যাবে, তবে মুখোশে মুখ ঢাকা যাবে না।"
সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট রমনার পশ্চিম পাশের লেকের ধারের বটমূল ঘিরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। 'স্বাভাবিকতা ও পারস্পরিক সম্প্রীতির সাধনা'- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সংগঠনটি আজ রোববার থেকে কাজ শুরু করবে। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে চলছে মহড়া। এ বছর খুদে ও বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ' শিল্পী মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন।
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, '১২ এপ্রিলের মধ্যে মঞ্চ তৈরি সম্পন্ন হবে। ঈদের দিন নববর্ষ প্রস্তুতির কাজ বন্ধ থাকবে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন মঞ্চে শিল্পীরা চূড়ান্ত মহড়ার অংশ নেবেন।'
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এবার যশোরে হবে তাদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি। এ ছাড়া খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, বরিশালে পহেলা বৈশাখের কর্মসূচি পালন করা হবে। এ ছাড়া উদীচী ঢাকায় ছায়ানটকে সহযোগিতা করবে।
ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে ঘরোয়াভাবে উদীচী কার্যালয়ে আনন্দ আয়োজন হবে জানিয়ে বাংলাদেশ উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, 'পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নানা বিধিনিষেধ আরোপ ও সময় সংকুচিত করা হচ্ছে। তাই পহেলা বৈশাখের আগের দিন ঢাকা কেন্দ্রিক বা সারা দেশে আমাদের প্রতিবাদী কর্মসূচি থাকতে পারে।'
বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে চলছে বর্ষবরণ সংগীত ও নববর্ষ বক্তৃতার আয়োজন। বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি উপবিভাগের উপপরিচালক সাইমন জাকারিয়া বলেন, 'পহেলা বৈশাখে সকাল ৮টায় বর্ষবরণ সঙ্গীত পরিবেশন করবেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা। নববর্ষ বক্তৃতা দেবেন রাজনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক ড. নুহ-উল-আলম লেনিন।'
সুরের ধারার আয়োজনে 'হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ' শিরোনামে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন ও অডিশন পর্ব শেষে বাছাই করা শিল্পীদের নিয়ে চলছে মহড়া। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত হাজারো শিল্পীরা এক মঞ্চে গান পরিবেশন করবেন।
সুরের ধারার কর্ণধার রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, 'ঈদের আনন্দের সঙ্গেই এবার যুক্ত হচ্ছে পহেলা বৈশাখের আনন্দ। সবাইকে নিয়ে এবার পহেলা বৈশাখের আনন্দ উদযাপন করার চেষ্টা করছি। এবার আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রমজান মাস চলছে। এরপর ঈদের ছুটি। আশা করি সব কিছু কাটিয়ে উঠতে পারব।'