চৈত্রের প্রথম থেকেই দেখা মিলছে ভাঁট ফুল। পথে প্রান্তরে ভাঁট ফুল সৌরভ ছড়াচ্ছে। গ্রামীণ সড়কের পাশে অবহেলা অনাদরে বেড়ে ওঠা এই ফুল কর্মে ছুটে চলা পথিকের ভালো লাগার কারণ হচ্ছে অজান্তে আনমনে। তবে বড় বড় অট্টালিকা ও পাকা রাস্তার ভিড়ে প্রকৃতি থেকে হারাতে বসেছে অপরূপ সৌন্দর্যের এই ভাঁট ফুল। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
নিয়ামতপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, শিমুল পলাশের ভিড়ে সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে ভাঁট ফুল। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার রাস্তার দুই পাশে, ঝোপঝাড়ে, পুকুরপাড়ে, পতিত জমিতে থোকায় থোকায় ফুটতে শুরু করেছে ভাঁট ফুল।
রাতের আঁধারেও ফুলটির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ায় চারপাশে। এটি একটি বুনো ফুল। অঞ্চলভেদে এ ফুল ভাঁট, ভেটি, ভাইট, বনজুঁই বা ঘেটু নামে পরিচিত।
ভাঁটের বৈজ্ঞানিক নাম ঈষবৎড়হফবহফৎড়হ ারংপড়ংঁস। ভাঁট গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। গাছের প্রধান কান্ড খাড়া, সাধারণত ২ থেকে ৪ মিটার লম্বা হয়। পাতা কিছুটা পানপাতার আকৃতির ও খসখসে। পাতা ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি লম্বা। ডালের শীর্ষে পুষ্পদন্ডে ফুল ফোটে। পাপড়ি সাদা, তাতে বেগুনি মিশেল আছে। ভাঁট মিয়ানমার ও ভারতীয় প্রজাতি।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা নওগাঁ বইয়ে লেখা আছে- নওগাঁ অঞ্চলে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ১ তারিখ থেকে চৈত্র মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বালিকারা একত্রিত হয়ে বসনবুড়ির পূজা করে। পূজার পুরোহিত ওই বালিকারা। বসনবুড়ির কোনো মূর্তি নেই। এর প্রতীকস্বরূপ আটিয়া-বিচি কলার গাছকে পূজা করা হয়। বাড়ির পেছনে কোনো স্থান পরিষ্কার করে গোবর দিয়ে মুছে একটি মাঝারি আকৃতির বিচি কলার গাছ পুঁতে তার গোড়াতে মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করতে হয়। পূজার ফুল হিসেবে জঙ্গলে ফুটে থাকা ভাঁট ফুলসহ আকন্দ ফুল, কাঁটাগর ফুল, কাঠমলিস্নকা ফুল, করবি ফুল, দই নাচুনি (ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ), ভূঁই ওকরা (ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ) ব্যবহৃত হয়। মূলত বসন্তকালে জঙ্গলে যেসব ফুল ফুটে সে সব ফুলই দেবীর পূজায় ব্যবহৃত হয়। গত কয়েকদিন আগে উপজেলার ভাবিচা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন কিশোরীকে ঝুড়িতে ভাঁট ফুল নিয়ে বসনবুড়ির পূজা করছে।
কিশোরী পূরবী সরদার জানাল, তারা পথের ধারে, ঝোপঝাড়, পুকুরপাড় থেকে এই ভাঁট ফুল সংগ্রহ করেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা এই ফুল তুলে পূজা করে।
নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার প্রভাষক মোদাচ্ছের হক প্রতিবেদককে বলেন, পলাশ, শিমুলের মতো বিশালত্ব না থাকলেও ভাঁট ফুলের সৌরভ বসন্তজুড়েই রাঙিয়ে যায় বন। কবির মনকে করে তোলে আরও কাব্যময়। ভাঁট ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। সাধারণত চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত প্রায় সারা দেশেই ভাঁট ফুলের সুবাস ও সৌন্দর্য আমাদের মাতিয়ে রাখে। এটি গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি বুনো ফুল।
চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রাস্তার আশপাশে ভাঁট ফুলের সমারোহ মনকে করছে সুভাষিত। রাস্তার পাশে, ঝোপঝাড়ে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই উদ্ভিদ সবুজ বহুপত্রী, ফুল ধবধবে সাদা। ফুল ফোটে থোকায় থোকায়। ভাট ফুলের পাপড়ি পাঁচটি এবং পাপড়ির গোড়ার দিকটা হালকা বেগুনি রঙের। ঋতুরাজ বসন্ত মানে নানা বর্ণের ফুলের আগমন। গ্রাম বাংলার অতিপরিচিত উদ্ভিদ ভাট ফুল। একসময় গ্রামীণ জনপথে ভাট গাছ দেখা গেলেও এখন বসতবাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ঝোপঝাড় কেটে ফেলায় বন-জঙ্গল নিধন করাসহ প্রতিবছর রাস্তাঘাট সংস্কার করায় গাছের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধন ছাড়াও ঔষধি গুণ রয়েছে। খেলার সামগ্রী হিসেবে শিশুদের কাছে জনপ্রিয় এই ফুল।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক বিপস্নব আচার্য্য বলেন, ভাট ফুলে আছে অনেক উপকারিতা রয়েছে। বিষাক্ত কিছু কামড় দিলে ফুলের রস ক্ষত স্থানে লাগালে দ্রম্নত সেরে যায়। অনেকে কৃমি দূর করার জন্য এ ফুলের রস খেয়ে থাকেন। চর্ম রোগে নিয়মিত ফুলের রস ক্ষত স্থানে মালিশ করলে দ্রম্নত সেরে ওঠে। গরু-ছাগলের গায়ে উকুন হলে ভাঁট গাছের পাতা বেটে দিলে উকুন মরে যায়। আগের লোকজন ভাঁট ফুলের ভেষজ ঔষধি গুণ জেনে এসব চিকিৎসা করত। বর্তমান প্রজন্ম এ গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে জানে না। তাই এ উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা জরুরি।
সংবাদকর্মী শংকর শীল বলেন, ভাঁট গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। পাতা দেখতে কিছুটা পান পাতার আকৃতির ও খসখসে। ডালের শীর্ষে একের পর এক ফুল ফোটে। পাপড়ির রং সাদা এবং পুষ্পমঞ্জুরির মাঝে কলির অগ্র ভাগের রং বেগুনি। রাতে বেশ সৌরভ ছড়ায়, মনকে করে সুভাষিত।