পা হারানোর পরেও জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন আকলিমার
প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি
সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারানোর যন্ত্রনা ও মনো কষ্টে আলস্নাহর কাছে মৃতু্যও কামনা করেছেন কলেজ ছাত্রী আকলিমা। একে তো নারী তার ওপর আবার পঙ্গুত্ব। হাসপাতালের বিছানায় এক বছর অসহায় জীবনযাপন করেছেন তিনি। মৃতু্য কামনার পরও তার মৃতু্য হয়নি, বরং সাফলতা অর্জনের সাহসটুকু তিনি পেয়েছেন। গর্ভধারিণী মমতাময়ী মায়ের পরামর্শে আকলিমা পড়া লেখা চালিয়ে গেছেন। এখন তিনি একজন সুনামধন্য স্কুল শিক্ষক। তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রাইপুর গ্রামের হাজি জোয়াদ আলীর মেয়ে। জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৬ মার্চ মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আকলিমা খাতুন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দুটি পা। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে এক বছর তার চিকিৎসা করানো হলেও পা দুটি আর সচল করা যায়নি। কোমর থেকে নিচের অংশটি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে তারমতো অসংখ্য মানুষকে দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। আবার লেখাপড়া শুরু করেন। পঙ্গুত্ব বরণ করার পর আকলিমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। জীবনের সব আশা-ভরসা শেষ এই ভেবে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের মৃতু্য কামনা করতেন আর অঝোরে কাঁদতেন। সেসময় তার পাশে কাউকে না পেলেও মমতাময়ী মা তাকে ছেড়ে যাননি। সব সময় আশা জুগিয়েছেন। মায়ের পরামর্শে আকলিমা আবারও পড়ালেখা শুরু করেন। অদম্য এই মেধাবী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেন এবং কৃতকার্য হন। বর্তমানে তিনি গাংনী উপজেলার রায়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত। পায়ে হেঁটে আসার সামর্থ্য হারালেও এখন সব ধরনের চলাচল তার হুইল চেয়ারে। আকলিমা জানান, তার জীবনের এই গল্পটা এতটা সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে এত দূর। জীবনের সেই দুঃসময়ে একমাত্র মা ছাড়া পরিবারের কেউ তেমন সহোযোগিতা করেনি। ভাইয়েরা বলেছিল অযথাই ওর পড়াশোনার পেছনে টাকা খরচ করে কি লাভ প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয়, তাদেরকে একটু সুযোগ করে দিলে সমাজে তারাও যে ভালো ভূমিকা রাখবে সেটা পরিবারের লোকজনকে বিশ্বাস করানোটা ছিল এক রকম চ্যালেঞ্জ। এখন পাশে অনেকেই আছেন এবং পরিবারের লোকজনও তার পাশে রয়েছে বলেও জানান আকলিমা। আকলিমার মা মমতাজ খাতুন জানান, আকলিমা মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। দুটি পা অচল হলেও লেখাপড়া বন্ধ করতে দেওয়া হয়নি। ছোট বেলা থেকেই সে মেধাবী। তার ওপর ভরসা ছিল। তাই নানা ধরনের বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেও তার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছি। এখন সে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করছে। সে তার সংসারের নিজের সব কাজ নিজেই করে, যেটি পারে না তখন তাকে সাহায্য করা হয়। প্রতিটি বাবা-মায়ের উচিত তার প্রতিবন্ধী, অক্ষম সন্তানকে বোঝা মনে না করে ভালো কিছু করার সুযোগ করে দেওয়া। ওই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, আকলিমা অন্যান্য শিক্ষকের মতোই শিক্ষা দেন। ভালোভাবে পাঠদান করান। সময়মতো স্কুলে আসেন। তিনি খুব আন্তরিক মানুষ। কেউ স্কুলে না আসলে হুইল চেয়ারে করে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেন। কখনো কারও সঙ্গে অসদাচরণ করেন না। বিদ্যালয়ের প্রধান ফৌজিয়ারা খাতুন জানান, আকলিমা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও আর পাঁচজনের মতোই তার কাজ নিজে করেন এবং প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেন। তিনি কোনো দিন দেরি করে স্কুলে আসেন না। শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তান মনে করে পড়ালেখা করান। গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন জানান, আকলিমা দৈহিকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও মানসিকভাবে অবিচল। সাধারণ মানুষের মতই সব কিছু করেন। শিক্ষাদান, বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া সঠিক সময়ে পাঠ দানে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাকে দেখে সমাজের আরও যারা এ রকম সমস্যায় রয়েছে তারা ঘুরে দাঁড়াবেন বলে তিনি মনে করেন।