অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের পথে ৪১৫ বছরের পুরনো মসজিদ
ঐতিহ্য হারাচ্ছে দেলদুয়ারের আতিয়া মসজিদ
প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
যুগ যুগ ধরে ইতিহাস ও ঐেিহ্যর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন স্থাপনার অন্যতম নির্দশন টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া জামে মসজিদ। রমজান মাস ঘিরে মসজিদটিতে কিছুটা বেড়েছে দর্শনার্থী ও নামাজ পড়তে আসা মুসলিস্নদের উপস্থিতি। একসময় ইতিহাস-ঐতিহ্যে বহনকারী ওই মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের দশ টাকার নোটে স্থান পেয়েছিল। বর্তমানে কোনো টাকার নোটেই এর ছবি দেখা যাচ্ছে না। অযত্ন-অবহেলায় মসজিদটি তার সৌন্দর্য হারিয়ে প্রায় ধ্বংসের পথে, এ যেন দেখার কেউ নেই। অথচ অযত্ন-অবহেলায় অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কায় পড়েছে ৪১৫ বছরের পুরনো ওই ঐতিহ্যবাহী আতিয়া জামে মসজিদটি। মুসলমানদের মধ্যে যুগের ইতিহাস-ঐতিহ্যে আতিয়া জামে মসজিদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বর্গাকৃতির গম্বুজবিশিষ্ট লাল ইটের তৈরি মসজিটিতে রয়েছে চমৎকার স্থাপত্যশৈলী। মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়ালে রয়েছে চমৎকার সব পোড়ামাটির নকশা। বারান্দার পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট তিন গম্বুজবিশিষ্ট বারান্দায় রয়েছে তিনটি প্রবেশদ্বার। মসজিদের কেবলা দেয়ালে তিনটি অলঙ্কৃত মেহরাব রয়েছে। প্রাচীনতম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নির্দশন ওই মসজিদটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিন দিন ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিগত ২০২৩ সালের শেষভাগে মসজিদটিতে সাময়িক চুনকাম ও রঙের কাজ করা হয়েছে জানিয়ে স্থানীয় মুসলিস্নরা বলেন, মসজিদটির চুনকাম ও রঙের কাজ নিম্নমানের হওয়ায় মাত্র ৬ মাসেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া একসময় বজ্রপাতে মসজিদের একটি মিনার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার কাজটিও সঠিকভাবে করা হয়নি। দায়সারাভাবে ভেঙে যাওয়া মেঝের পস্নাস্টার করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ কাজ নিয়ে এমন নানা অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় মুসলিস্নদের। সাঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মসজিদটি প্রায় ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে বলেও জানায় তারা। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মসজিদটি তার অস্তিত্ব হারাতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথচ একসময় মসজিদটির ঐতিহ্যর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ টাকা মূল্যমানের নোটে মসজিদটির ছবি মুদ্রণ করা হতো। সে কারণে সেসময়ে দেশ ও দেশের বাইরের সবার কাছে মসজিদটির পরিচিতি ছিল ব্যাপক। জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা না হলে মসজিদটি একসময়ে পুরোপুরি তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে। দেশের প্রাচীনতম স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নির্দশন হলো আতিয়া জামে মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদটি উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের আটিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটির প্রবেশ পথের মূল ফটক থেকে জানা গেছে, তৎকালীন আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা সাইদ খান পন্নী ১৬০৯ খ্রি. মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর দিলিস্নর একজন মহিলা বণিক রওশন খাতুন চৌধুরানী ১৮৩৭ খ্রি. এবং দেলদুয়ারের জমিদার আবু আহমেদ গজনবী খান ১৯০৯ খ্রি. মসজিদটির সংস্কারের কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার মসজিদটি পুরাকৃর্তি বা প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে অধিগ্রহণ করে। বিভিন্ন পুস্তক থেকে জানা গেছে, আরবি 'আতা' শব্দ থেকে 'আতিয়া' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ হলো 'দানকৃত'। সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ পঞ্চদশ শতকে হজরত শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.)-কে টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ করেন। সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং আনুষঙ্গকি ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ হিসেবে পান। দৃষ্টিনন্দন ওই মসজিদটি লাল ইট দ্বারা নির্মিত। মসজিদটির পূর্ব ও উত্তর পাশের দেয়ালে পুরুতে রয়েছে আকর্ষণীয় খোদাই করা নকশা অলংকৃত। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুইটি করে দরজা রয়েছে এবং পূর্ব দিকে তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার ও প্রস্থ ১২.১৯ মিটার এবং দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার। এছাড়া বারান্দার দৈর্ঘ্য ৩.৮২ মিটার ও প্রস্থ ৭.৫ মিটার। মসজিদটির চারকোনে ৪টি অষ্টকোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে গিয়ে ছোট গম্বুজ আকৃতি ধারণ করছে। প্রধান গম্বুজটি আকারের যা আর্চভিত্তিক স্কুইঞ্চ পদ্ধতিতে নির্মিত হয়েছে। আটিয়া গ্রামের ওসমান মিয়া (৮৫) জনান, তিনি ওই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। রমজান মাস উপলক্ষে মসজিদে মুসলিস্নদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে দিন দিন মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে মসজিদটির প্রাচীন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আতিয়া জামে মসজিদের মোয়াজ্জেম রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ওই মসজিদে চাকরি করছেন। মসজিদটি প্রাচীনতম স্থপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন। মসজিদটির দ্রম্নত সঠিকভাবে সংস্কার কাজ না হলে একসময় মসজিদটির অস্তিত্ব পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আতিয়া জামে মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি আশরাফ হোসেন মানিক জানান, ৬ থেকে ৭ মাস আগে মসজিদটির কিছু কারুকার্য করা হয়েছে। কাজটি একবারেই নিম্নমানের হয়ছে। মাত্র ৬/৭ মাসের মধ্যেই যে চুনকাম ও রঙের কাজ করা হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দিন দিন মসজিদটির কারুকার্য নষ্ট হয়ে ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। এভাবে অবহেলিত অবস্থায় থাকলে একসময় মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।