ডুমুরিয়ায় কচুরিপানা ফুলে প্রকৃতি মেতেছে নতুন রূপে

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ডুমুরিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি
খুলনার ডুমুরিয়ায় মাগুরথালী নদীর মির্জাপুর এলাকায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কচুরিপানা ফুল -যাযাদি
কথায় বলে যার দোষ; তার কিছুটা হলেও গুণ আছে! নদীর পানি নিষ্কাশনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো সেই কচুরিপানা নামক আগাছা মার্চ বসন্তে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। পানির ওপর বিছানো সারি সারি সবুজ পাতা আর ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ হচ্ছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ। শুধু খুলনার ডুমুরিয়া এলাকা নয়, শস্য-শ্যামল সবুজে ভরা এ বাংলাদেশে অধিকাংশ বদ্ধ খাল-বিলে শোভাবর্ধন পাচ্ছে 'কচুরিপানা ফুলে'। ডুমুরিয়া উপজেলার খড়িয়া-মির্জাপুর মঠ ও বৃদ্ধাশ্রমের পাশে মাগুরখালী নদীর বদ্ধজলাশয়ে সৌন্দর্যের পাপড়ি মেলে ধরা কচুরিপানা ফুলের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই তুলছেন সেলফি। চোখ জুড়ানো সবুজ পাতার মাঝে হালকা গোলাপি রঙের কচুরিপানা ফুলের উঁকি হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। কচুরিপানা দেখতে গাঢ় সবুজ হলেও এর ফুলগুলো সাদা পাপড়ির মধ্যে বেগুনি ছোপযুক্ত এবং মাঝখানে হলুদ ফোটা থাকে। সাদা এবং বেগুনি রঙের মিশ্রণে এক অন্যরকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সাদা পাপড়ির স্থলে কোথাও হালকা আকাশি পাপড়ি দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায় সাত প্রজাতির কচুরি দেখতে পাওয়া যায়। কচুরি ফুলের মুগ্ধতায় আমাদের প্রকৃতি প্রেম জাগ্রত হয়। ছবি তুলতে আসা মির্জাপুরের নিলয় মন্ডল জানান, কচুরিপানা ফুলে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে মাগুরখালী নদীর মির্জাপুর মোহনায়। সুবাস না ছড়ালেও বসন্তে ফোটা এ ফুলে রয়েছে নান্দনিক রূপ। দৃষ্টিনন্দন কচুরিপানা ফুলে আকৃষ্ট করছে সৌন্দর্য পিপাসুদেরকে। খানজাহান আলী আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আশীষ কুমার মন্ডল জানান, 'কচুরিপানা আমাদের খালগুলো শত্রম্নর মতো দখল করে রাখলেও তার ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য এতটাই হৃদয়হারিণী যে আমরা বিমোহিত না হয়ে পারি না।' জানা গেছে, কচুরিপানা আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। কচুরিপানা ভাসমান ও বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এ খুবই দ্রম্নত বংশবিস্তার করতে পারে এবং প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করে যা ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করে এবং দু'সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কচুরিপানার অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্য প্রেমিক এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮শ' শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। তারপর তা এত দ্রম্নত বাড়তে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। নদ-নদীতে চলাচল সুঃসাধ্য হয়ে পড়ে আর জলাভূমির ফসল আমন ধান আর পাট চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে বাংলার অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করা হয়, যার মাধ্যমে বাড়ির আশপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেয়াকে নাগরিক কর্তব্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সবগুলো দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ মুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে বিজয় লাভ করে তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালান। কচুরিপানার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের সাফল্য লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সার হিসেবে পঁচানো কচুরিপানার উৎকৃষ্টতা। এই গুণের কারণে ভূমিহীন কৃষকরা কচুরিপানা জমিয়ে ভাসমাস কৃষিজমি তৈরি করতে শুরু করেন। ১৯৪৭ এর মধ্যে বাংলার জলাশয়গুলো কচুরিপানা বদ্ধতা থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হয়। যদি এখনো বিশেষ করে বদ্ধ জলাশয়ে কচুরিপানা বহাল তবিয়তেই আছে। মাগুরখালী, শোলমারি, আমকুড়া, গগনা, দোয়ানেসহ শত শত খালে ভরে গেছে কচুরিপানায়। বর্তমানে এসব খাল দিয়ে নৌকা-ডিঙ্গি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিবাকে পড়েছেন কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কচুরিপানার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী। আমাদের বীর মুক্তিসেনারা যখন গেরিলা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে খাল বিলে লুকিয়ে থাকত তখন এই সামান্য বৃক্ষই তাদেরকে মায়ের মতো আচল দিয়ে লুকিয়ে ফেলত।