রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার সীমান্তে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও একমাত্র সীমান্ত সড়ক। এ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ের দৃশ্যপদ বদলে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই সেনাবাহিনী ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এ সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ সীমান্ত ও সংযোগ সড়কের ১,০৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর মধ্যে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ও রাঙামাটি-বান্দরবান-খাগড়াছড়ি জেলা।
ইতিমধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটার প্রকল্পের মধ্যে ২২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৪৭ কিলোমিটারের কাজ চলমান রয়েছে, যা চলতি বছরের জুন মাস নাগাদ শেষ হবে। এ সড়ক নির্মাণ হলে ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, তেমনি রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সীমান্তে নিরাপত্তা, ও পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ২০১৯ সাল থেকে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজের সূচনা করা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট ওপরে দুর্গম উঁচু পাহাড় কেটে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। এ প্রকল্পের এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সীমান্ত সড়ক করা হবে। এর মধ্যে একনেকে অনুমোদিত প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটার প্রকল্পের মধ্যে ৯৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আরও ১৩২ কিলোমিটার চলমান কাজ শেষ হবে চলতি বছরের এপ্রিলে। অবশিষ্ট ৯০ কিলোমিটার কাজ শেষ হবে ২০২৪-এর জুনে। সীমান্ত সড়কের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২২০ কিমি ও সংযোগ সড়ক ৯৭ কিমি। এর মধ্যে মিয়ানমার সীমান্তে ৯৬ কিমি (সীমান্ত থেকে ৭৫ গজের মধ্যে) ও ভারত সীমান্তে ১২৪ কিমি (সীমান্ত থেকে ১৫০ গজের মধ্যে)।
সীমান্ত সড়কের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ৩৬০ কিমি (প্রস্তাবিত ডিপিপি) এবং তৃতীয় পর্যায়ে ৩০৭ কিমি (সম্ভাব্য), টিআরএমএল রোড রয়েছে ৫২ কিমি। সম্প্রতি সীমান্ত সড়ক ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শেষ করতে কাজ পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উলস্নাহ নুরী। এসময় সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন কোরের ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ (ইএনসি) মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস, মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস, প্রকল্প পরিচালক কর্নেল ভুইয়া মো. গোলাম কিবরিয়াসহ সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের ও সেনা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে সীমান্ত সড়ক নির্মিত হওয়ায় ভবিষ্যতে আশার আলো দেখছেন দুর্গম পাহাড়ের স্থানীয় লোকজন। তাদের আশা এ সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ হবে ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং পাহাড়ের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্য-প্রযুক্তি, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তনে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। ফারুয়া ইউনিয়নের তক্তানালার বাসিন্দা উদোয়মালা তংচংগ্যা, গোলাক তংচংগ্যা, সুগত তংচংগ্যা, রোয়াপাড়া বাসিন্দা টনি মারমা জানান, এ সড়কটি নির্মাণের কারণে তারা পাহাড়ে উৎপাদিত পণ্য সহজেই বাজারজাতসহ যাতায়াত করতে পারছেন। আগে পায়ে হেঁটে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। এছাড়া একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে প্রচুর সময় লাগত। এখন গাড়িতে করে উপজেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগছে।
সেখানকার স্থানীয় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক অমর শান্তি তংচংগ্যা জানান, সড়কটি হওয়ায় তিনি এখন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। প্রতি মাসে তার ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার আয় দিয়ে তার সংসার ভালো করে চলছে। অপর মোটরসাইকেল চালক জীবন জয় তংচংগ্যা বলেন, বিলাইছড়ি ফারুয়া থেকে কাপ্তাই ও বান্দরবানে যেতে অনেক সময় লাগত। এখন সকালে গিয়ে বিকালে আসা সম্ভব হচ্ছে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল ভুঁইয়া মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, দুর্গম এলাকার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখেছেন বলে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন কোরকে সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের আনাগোনা থাকায় নিরাপত্তার ঝুঁকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নির্মাণ সামগ্রী, শ্রমিকের সংকটসহ নানা প্রতিকূলতা ও বাধার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তার পরও সেনাবাহিনী নিরলস প্রচেষ্টায় সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি গুণগত মান নিশ্চিত করে সম্পন্ন করছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উলস্নাহ নুরী বলেন, দুর্গম এলাকায় হওয়ায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কঠিন কাজটি সেনাবাহিনী করছে। প্রথম পর্যায়ে এ সীমান্ত সড়কের কাজ চলতি বছরে মে মাসের মধ্যে শেষ হবে। শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে উদ্বোধনের জন্য। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। পরবর্তী সময়ে তৃতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু করা হবে। তবে সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, দুর্গম এলাকায় হওয়ায় আবাহাওয়াগত বৃষ্টিপাত, পাহাড়ধস, মালামাল আনা-নেওয়া ও সরঞ্জাম নিয়ে যেতে সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সেনাবহিনীকে কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে।