দেলদুয়ারে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় লেবু চাষিরা

প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে বিক্রির জন্য লেবু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকেই -যাযাদি
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের লেবু চাষিরা নানা প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় লেবু বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা চলতি রমজানে লেবুর ভালো মূল্যে পেয়ে নতুন করে লেবু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। উপজেলার লেবু চাষিরা লেবুর লাভজনক মূল্য পেয়ে লেবু বাগানের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়েছে। সকাল থেকেই অধিকাংশ লেবু চাষি বাগান থেকে লেবু সংগ্রহের কাজ করেন। পরে সেগুলো পাইকার ও খুচরা বাজারে লাভজনক মূল্যে বিক্রি করেন। এছাড়া লেবু বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকেই। জানা গেছে, বিগত ২০২০ সালের বন্যার পানিতে অনেক লেবু বাগান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত লেবুর তেমন দামও পাননি লেবু চাষিরা। সে কারণে ওই সময়ে অনেকেই লেবু চাষ ছেড়ে ওই জমিতে অন্য শস্য চাষ শুরু করেন। এক সময় এ অঞ্চলে লেবুর উৎপাদন ব্যাপক পরিমাণে হওয়ার কারণে উপজেলার ফাজিলহাটি ইউনিয়নের পুটিয়াজানি এলাকায় লেবুর হাট জমে উঠেছিল। অথচ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং লেবু দাম না পেয়ে অনেক কৃষকই লেবু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর লেবু হাটেরও বেহাল অবস্থা হয়। অথচ সে দুর্দিন কাটিয়ে লেবু চাষিরা আবার লাভের আশায় লেবু বাগানে আগ্রহী হচ্ছে। তারা বর্তমানে দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকছেন লেবু বাগানে। ভালো ফলনের আশায় লেবু চাষিরা যেন মন বসিয়ে লেবু বাগানের যত্ন নিচ্ছেন। এতে লেবু লাভজনক দামে বিক্রি করে নিজেদের লাভের আশাও করেন তারা। তবে লেবু চাষে সরকারি প্রণোদনা দাবি করে লেবু চাষিরা জানান, লেবু চাষে সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। লেবু চাষে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মধ্যে সরকার সুদমুক্ত ঋণ কার্যক্রম চালু করলে পুনরায় পুঁজি গঠনের মাধ্যমে দ্রম্নত লেবু চাষের সম্প্রসারণ হতে পারে বলে মনে করেন লেবু চাষিদের অনেকেই। এদিকে কৃষিবিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে লেবু বাগান পরিচর্যায় কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের লাউহাটি, তাঁতশ্রী, তারুটিয়া, হেরেন্ডপাড়া, দারিয়াপুর, ফাজিলহাটি ইউনিয়নের ফাজিলহাটি, পুটিয়াজানি, ভবানীপুর, শৈলকড়িয়া, বিলসা, আটিয়া ইউনিয়নের নালস্নাপাড়া, গড়াসিন, হিংগানগর, এলাসিন ইউনিয়নের এলাসিন, নয়াচর গ্রামসহ আশে-পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে লেবু চাষ করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের লেবু চাষিরা দিনের বেশির ভাগ সময় লেবু সংগ্রহ, বিক্রি ও বাগানের পরিচর্যায় যেন ব্যস্ত সময় পার করছেন। লেবু বিক্রি করেন বস্তা চুক্তি, ওজন ও পিস হিসেবে। বর্তমানে প্রতিটি লেবুর মান অনুযায়ী খুচরা মূল্য ৩ থেকে ৮ টাকা। এছাড়া মান অনুসারে পাইকারী মূল্য প্রতিটি ২ থেকে ৭ টাকা। অন্যদিকে প্রতি কেজি লেবুর খুচরা মূল্য ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ উপজেলা অঞ্চলের বেশিরভাগ লেবুই সীডলেস কলম্বো জাতের। এ লেবুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য সুগন্ধিযুক্ত পাতলা আঁশ, বীজমুক্ত ও রসে পরিপূর্ণ। সে কারণে এখানকার লেবু সারা দেশেই জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তা থাকায় এক সময় সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। বন্যায় বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে লেবুর চাহিদা যোগানে কিছুটা ভাটা পড়ে। দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বর্তমানে ৪২১ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ করা হচ্ছে। এর আগে এ অঞ্চলে প্রায় ৮শ' হেক্টর জমিতে লেবুর চাষ হতো। অথচ ২০২০ সালের বন্যায় লেবু বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় অনেক কৃষক লেবু বাগান ভেঙে ওই জমিতে সরিষা ও ভুট্টাসহ অন্য ফসল চাষ করছেন। এছাড়া ওই সময় লেবু বিক্রি করে লাভজনক মূল্যও পাননি চাষিরা। সে কারণে উপজেলায় শতকরা ৪০ ভাগ লেবু চাষের জমি কমে গেছে। তবে লাভজনক মূল্যে বিক্রি করতে পারলে নতুন করে লেবু চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়বে বলেও জানায় উপজেলা কৃষি বিভাগ। নালস্নাপাড়া গ্রামের লেবু চাষি রব্বানী মিয়া (৬০) জানান, তিনি এ বছর ১৫০ শতাংশ জমিতে সীডলেস কলম্বো জাতের লেবু আবাদ করেছেন। এছাড়া রমজানে লেবুর ভালো দাম পাওয়ার জন্য আগে থেকেই বাগানের গুরুত্বসহকারে পরিচর্যা করেছেন। চলতি মৌসুমে লাভজনক মূল্যে লেবু বিক্রি করতে পেরে তিনি অনেক খুশি। একই গ্রামের লেবু চাষি ও লেবু গ্রাম লেবু চাষী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম আল মামুন মিল্টন জানান, তিনি প্রায় ৫ একর জমিতে লেবু চাষ করেছেন। তবে তিনিসহ অনেকেই লেবু চাষে বিগত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো চাষিই আজও সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। সরকারি সুদমুক্ত ঋণ দাবি করে লেবু চাষে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি। পুটিয়াজানি গ্রামের লেবু ব্যবসায়ী নূরুল হক ব্যাপারী ও সোনা মিয়া জানান, তারা প্রায় ১৭ বছর ধরে লেবুর ব্যবসা করছেন। বর্তমান বাজারে লেবুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুয়ায়ী লেবুর যোগান দিতে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। সে কারণে তারা লেবু ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রতিদিন হাটে বসেন। আটিয়া ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল হোসাইন জানান, লেবু চাষের জন্য আলাদা কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না। তবে তিনি মাঠে গিয়ে লেবু বাগানের পরিচর্যা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে চাষিরা আগে থেকেই লেবুর রোগ-বালাই সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। ফলে তারা রোগ-বালাই থেকে লেবুর ক্ষতি হওয়ার প্রতিকার করতে পারছেন। দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার মাহবুবুল হাসান জানান, দেলদুয়ারে বর্তমানে ৪২১ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে লেবু চাষ হচ্ছে। এছাড়া চলতি রমজান মাস ঘিরে বাজারে প্রতি কেজি লেবু ৮০ থেকে ১০০ টাকা হারে খুচরা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এতে লেবু বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। তবে লাভজনক মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হলে নতুন করে লেবু চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়বে।