বগুড়ায় 'দৈত্যর চাকা'য় চুড়মার শত শত কোটি টাকার রাস্তা
প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
আতঙ্ক কাটছেই না সাধারণ মানুষদের। প্রতিনিয়ত সন্ধ্যার পর থেকেই নেমে সারারাত দাপিয়ে বেড়ায় মাটি বহনকারী দৈত্যাকার ড্রাম ট্রাক। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে সরকারের শত-শত কোটি টাকার রাস্তা। গত প্রায় বছর দুই হলো এই অত্যচারে অতিষ্ঠ বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, গাবতলী, সাজাহানপুর, শেরপুর, ধুনট, শীবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। অন্য উপজেলাগুলোতেও রয়েছে এদের কু-নজর। এছাড়া পাশের গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ উপজেলাতেও একই অবস্থা।
সন্ধ্যা হলেই দেখা মিলবে এই দৈত্যের। তবে মাস কয়েক আগে দিনেও দেখা মিলত। বর্তমানে অজ্ঞাত কারনে তারা সন্ধ্যার পরেই নেমে পরে। এদের থামাতে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসীর চেচামেচি ও সচেতন মহলের নানামুখী পদক্ষেপ দেখা গেলেও বর্তমানে সবই নিস্তব্দ। কারণ সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে এই অত্যচার, আর সচেতন মহল নানা ধরনের ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকিতে বর্তমানে শুধু চোখ মেলেই দেখছেন।
গ্রামের মানুষগুলো দৈত্য বললেও এগুলো আসলে ড্রাম ট্রাক। রাতের আধারে দৈত্যের মতো দাপিয়ে বেড়ানোর কারণেই এই ট্রাক দৈত্য নামে পরিচিত। উপজেলা শহর থেকে মহাসড়কগুলোর সংযোগ রাস্তাগুলো সাধারণত ২৫ টন ওজনের গাড়ি চলাচরের জন্য বৈধ্য। কিন্তু বালু ও মাটিভর্তির পর এসব ট্রাককের ওজন দাড়ায় ৪০ থেকে ৫০ টন পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি রাতে অবৈধভাবে শত শত ট্রাক চলাচলের কারণেই এদের নাম হয়েছে দৈত।
নদীর কিনারা থেকে চার লেন মহাসড়ক পর্যন্ত এই দৈত্যদের পদাচারণা ছোট-বড় সব রাস্তায়। এমনকি মেঠোপথ ও বাড়ির উঠানেও রয়েছে এদের চাকার পিষ্টতা। ওদিকে সরকারি কর্তারা ছাড়াও কোটি-কোটি টাকার এই বাণিজ্যকে লুফে নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন ছোট বড় ও পাতি নেতারাও। এরা শুধু রাস্তা বিনষ্ট করেই থেমে নেই। ছোট-বড় দুর্ঘটনা তাদের নিত্য-নৈমত্তিক বিষয়, রয়েছে নিহতের ঘটনাও। তবে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারনে দুর্ঘটনা ও নিহতের ঘটনাতেও কোনোই প্রভাব পরেনি দৈত্যর মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারীদের ওপর।
এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন পৌর মেয়রের সঙ্গে। তারা বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে বহুবার প্রশাসনকে অবগত করেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।' সোনাতলা পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আকন্দ নান্নু বলেন, 'এসব বালু ব্যবসায়ীদের অত্যচারে আমার পৌর এলাকার সব রাস্তা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে বহুবার জানিয়েছি কিন্তু কোনোই কাজ হয়নি।'
এ বিষয়ে সোনাতালা, সারিয়াকান্দি, গাবতলী ও সাজাহানপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে কয়েকবার জানতে চাইলে তারা বরাবরই বলেছেন, 'এসব ঘটনায় যদি এলজিইডির পক্ষ থেকে অভিযোগ কিংবা গাড়িগুলো আটক করে আমাদের জানানো হয় তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেহেতু রাস্তাগুলো এলজিইডির।'
এ বিষয়ে এলজিইডির উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু তারা বলেন, 'বিষয়টি প্রশাসনের, তাই আমরা এটির কিছুই করতে পারব না।'
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউনুছ হোসেন বিশ্বাস বলেন, 'এ বিষয়টি একান্তই প্রশাসনের। কারণ ট্রাফিক নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের কাছে। আমাদের রাস্তার ক্ষতি হলেও করার কিছুই নেই।' রাস্তায় কত টনের গাড়ি চলাচলের বৈধতা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু যমুনা সেতুর পূর্বে কোনো ওজন স্কেল নেই, সে কারণে কত টনের গাড়ি চলছে তা পমিাপ করা মুশকিল।
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, ড্রাম ট্রাক নামের গাড়িগুলো ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে চলাচল একেবারেই অবৈধ। এদের কারণে কোটি কোটি টাকার রাস্তার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এগুলো থামাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, নদী থেকে বালু উত্তলনের কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। উত্তলনকৃত বালুর অর্ধেক যেখানে রাখা হয় সেই জমি মালিককে দেওয়া হয়। বাকি অর্ধেক বালুর মধ্যে কিছু দেওয়া হয় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। অবশিষ্ট বালু নিলামের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়। এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
তিনি আরও বলেন, উত্তলনকৃত বালু কিভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই বিষয়টি দেখবে প্রশাসন ও এলজিইডি। যেহেতু অধিকাংশ রাস্তা তাদের। তবে এসব বালুর ট্রাক চলাচলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এসব বালু পরিবহনের সময় যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা মেরামত করতে সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
বগুড়া সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নদী থেকে উত্তলনকৃত বালুগুলো ফোরলেন মহাসড়কের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে যেসব ট্রাকে পরিবহণ করা হচ্ছে সেগুলো ওইসব রাস্তার জন্য একেবারেই অবৈধ। তাই এগুলোকে থামাতে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে বগুড়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিগ্ধ আক্তার বলেন, এসব অবৈধ ট্রাক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে সার্জেন্ট পাঠানো হচ্ছে। আগামীতে আরও তৎপরতা বাড়ানো হবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সত্যিই রাস্তাগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে আমরা দিনের বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছি, যার কারণে তারা সময় বদলিয়ে আবার রাতে শুরু করেছে এটিকে থামাতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সবাইকে চেষ্টা করতে হবে।'