ধান-চালের রাজ্য বলে পরিচিত দেশের সীমান্তবর্তী বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা নওগাঁয় এখন আমের রাজত্ব। আমের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে দেশজুড়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে জেলাটি। শুধু তাই নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। ঘুরেছে চাষিদের ভাগ্যের চাকা। চলতি মৌসুমে উৎপাদনে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙবে বলে ধারণা করছেন আমচাষি ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে জেলায় আমের হিমাগার (সংরক্ষাণাগার) না থাকায় প্রতি বছর প্রায় কয়েকশ' কোটি টাকার আম নষ্ট হচ্ছে। হিমাগারসহ ফুড প্রসেসিং কোম্পানি গড়ে তোলা হলে অর্থনৈতিকভাবে এ জেলা আরও এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।
আম চাষিরা বলছেন, বর্তমানে গাছে গাছে আমের মুকুল আসায় পরিচর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। বিশ্ববাজারে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারলে আরও লাভবান হবেন। আম গবেষণা কেন্দ্র, সংরক্ষাণাগার ও প্রসেসিং কোম্পানি স্থাপনের দাবি চাষিদের।
২০২১ সালে এ জেলার আম্রপালি আমের মধ্য দিয়ে রপ্তানি শুরু হয়। ২০২৩ সালে ৭ জন চাষির মাধ্যমে ২২১ মেট্রিক টন আম্রপালি ও বেনানা ম্যাংগো ইতালি, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন ও কাতারসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়। ২০২২ সালে ৭৮ মেট্রিক টন রপ্তানি হয়েছে। যদি আম রপ্তানি পদ্ধতি সহজলভ্য করা যায় তাহলে জেলা থেকে আরও বেশি আম রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করছেন চাষিরা। জেলায় বছরে আমের বাণিজ্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে প্রায় ১৫ হাজার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে আম সংগ্রহের মৌসুমে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
বরেন্দ্র এগ্রো পার্কের স্বত্বাধিকারী সোহেল রানা বলেন, 'প্রতি বছর ঝড়-বৃষ্টি ও পাকা আম নষ্ট হয়। এসব আমরা কোনো কাজে লাগাতে পারি না। এর পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আম সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বছরে এ ক্ষতি হচ্ছে। যদি সংরক্ষণ ও প্রসেসিং করা যায় বছরে হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন সম্ভব।'
জেলার সাঁপাহার উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের আমচাষি নুরুজ্জামান বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষে সার, কীটনাশক, পানি ও শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ পড়ে, যা থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় সম্ভব। তবে যারা জমি ইজারা নিয়ে আম চাষ করেন তাদের আরও প্রায় ২৫ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়।
চাষি প্রদীপ কুমার বলেন, যাদের জমি আছে তারা বছর চুক্তি হিসেবে ইজারা দিয়েছেন। সেখানে আম বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এতে বরেন্দ্র ভূমি এখন সবুজে পরিণত হয়েছে। বছর বছর বাড়ছে আম বাগানের পরিমাণ। ফলে জমির মালিক, চাষি ও শ্রমিক সবাই লাভবান হচ্ছেন।
সাঁপাহার উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান হোসেন বলেন, এ উপজেলা খরাপ্রবণ। বৃষ্টিনির্ভর একমাত্র ফসল আমন ধানের আবাদ হতো। তবে এক যুগের ব্যবধানে মাঠের পর মাঠ এখন আম বাগানে সবুজে-শ্যামলে ছেয়ে গেছে। আম সংরক্ষণের জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হলে এ জেলা আরও এগিয়ে যাবে।
নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক অমিয় কুমার দাস বলেন, জেলা আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। তবে আম সংরক্ষণাগার বিশেষ করে হিমাগার ও ফুড প্রসেসিং করা জরুরি। বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে এসব তৈরি সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। এছাড়া আম রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার মজুত হওয়ার পাশাপাশি দেশ অর্থনৈতিক দিকে আরও এগিয়ে যাবে।
জানা গেছে, জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা সাঁপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলার প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল আমন ধান ও গম। পানি স্বল্পতার কারণে এক সময় এসব এলাকায় বৃষ্টিনির্ভর একটিমাত্র ফসল আমন ধানের ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে গত একযুগের ব্যবধানে বরেন্দ্রের মাঠগুলো এখন সবুজে ছেয়ে গেছে। ধানের আবাদ ছেড়ে চাষিরা এখন আম চাষে ঝুঁকছেন। আম চাষ শুরুর পর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রতিবছরই বাড়ছে বাগানের পরিমাণ। বরেন্দ্র এলাকা হওয়ায় এখানকার আম সুস্বাদু ও সুমিষ্ট। জেলায় আম্রপালি, গোপালভোগ, ফজলি, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, হিমসাগর, হাঁড়িভাঙা, আশ্বিনা, বারী-৪ ও গুটি জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় জেলায় ৬০ শতাংশ বাগানই আম্রপালি। এ জেলার আম ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। তবে আমের হিমাগার না থাকায় প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আম নষ্ট হয়।
মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, মৌসুমের শুরু থেকে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন তিনি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, এ বছর জেলায় আম বাগানের পরিমাণ ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর। যা থেকে প্রায় ৪ লাখ ৩১ হাজার টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে আম বাগান। রপ্তানির পরিসর বাড়াতে উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমের ফুড প্রসেসিং প্রক্রিয়াজাত করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে।
আম গবেষণা কেন্দ্র, সংরক্ষাণাগার, প্রসেসিং কোম্পানি স্থাপন ও বিশ্ববাজারে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে কৃষিবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন নওগাঁর লাখো কৃষক।